Bangladesh

ফের ওষুধের দাম বাড়াতে তোড়জোড়

গত দুই বছরে প্রায় সব ধরনের ওষুধের কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির পর আবারও নতুন করে দাম বাড়াতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করেছেন ওষুধশিল্প মালিক সমিতির নেতারা। তাঁরা বলছেন, ব্যাংকঋণের সুদ, জ্বালানি খরচ এবং ডলারের চড়া দরের কারণে ওষুধের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু উৎপাদন খরচ, লভ্যাংশের হিসাব কষে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবে যৌক্তিক হতে পারে না।

এমনিতেই প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকায় বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। তাই জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। এখানে মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে ধীরে ধীরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে ওষুধ উৎপাদনের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন ভ্যাট, ট্যাক্স কমানোর তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে গত কয়েক দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিক সমিতির নেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তাঁরা বলেছেন, ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দর, জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়া ও কাঁচামাল ক্রয়ে ডলার সংকট ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল মুক্তাদির বলেন, ‘এখন ডলারের দাম বেড়ে অফিশিয়ালি ১১০ থেকে ১১১ টাকা হয়েছে; আগে যা ছিল ৮৬ টাকা। এর মধ্যেই আমরা ওষুধের জোগান দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এ রকম অবস্থায় আর বেশি দিন চলা সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর, যাতে মানুষের জন্য সহনশীল হয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়ানো হবে।’ 

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘ওষুধের কাঁচামাল কিনতে আমরা এলসি খুলতে পারছি না। ব্যাংক বলছে, আপনারা আগাম টাকা দেন।

কেউ ২০ শতাংশ, কেউ ৩০ শতাংশ দিয়েছে। এখন দাম বাড়ানো নিয়ে আমরা নিজেরা আলোচনা করছি। পরে দামের বিষয়টি প্রস্তাব করব।’ 

গত দুই বছরে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে দুই দফা প্রজ্ঞাপন দেওয়া হলেও বাজারে থাকা ৯০ শতাংশের বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে। ২০২২ সালের ২০ জুলাইয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এর পাঁচ মাসের মধ্যে ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টি ওষুধের দাম বাড়ায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য মতে, গত বছরের মে মাসে দেশের শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠানের উৎপন্ন ২৩৪টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে এর কোনো প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেনি ঔষধ প্রশাসন।

সূত্র বলছে, ঔষধ প্রশাসন শুধু ১১৭টি অত্যাবশকীয় জেনেরিক ওষুধের দাম নির্ধারণ করে এবং দাম বাড়ানো হলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বাকি অন্য কোনো ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয় না।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র নুরুল আলম বলেন, ‘বাজারে প্রায় এক হাজার ৭০০ জেনেরিক ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে ১১৭টি জেনেরিকের ৪১৭ অত্যাবশকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। অন্যগুলোর বিষয়ে কম্পানিগুলো কাঁচামাল, উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং খরচের বিষয়ে জানিয়ে ভ্যাট প্রদানের নিমিত্তে মূল্য নির্ধারণের জন্য ঔষধ প্রশাসনে দাখিল করে। ঔষধ প্রশাসন যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন করে।’ 

ওষুধশিল্প মালিক সমিতির তথ্য মতে, দেশে ২১৩ স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। যারা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে। দেশে ওষুধের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের ১৫৭ দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত সাত বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এমনিতেই ওষুধের দাম অনেক বেশি। এর মধ্যে গত দুই বছরে ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে অনেক রোগী, যারা ক্রনিক রোগে ভোগে, বিশেষ করে ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগের ওষুধ খেতে হয়, তারা নিয়মিত ওষুধগুলো খেতে পারছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের দাম অত্যন্ত বেড়ে গেছে। এর মধ্যে যদি ওষুধের দাম আরো বাড়ে, সেটা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় সামগ্রিক ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে। মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।’

তিনি বলেন, ওষুধের দাম নির্ধারণ হওয়া উচিত দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। শুধু উৎপাদন খরচ, লাভ এগুলো মুখ্য হতে পারে না। এখানে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে ধীরে ধীরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য মতে, চিকিৎসাপ্রার্থীদের ৬৪.৬ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। বাকিটা ব্যয় হয় রোগ নির্ণয় বা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসক  দেখানো, হাসপাতালে ভর্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা নেওয়ার পেছনে। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ; অর্থাৎ তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে তা কমেছে। বিপরীতে ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজ ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে তা বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘ওষুধের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির খরচ বাড়বে। তবে ডলার সংকটসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা ওষুধের দাম বাড়তে চাইবেন, এটা স্বাভাবিক। কারণ কেউ লোকসান দিয়ে ব্যবসা করতে চাইবেন না। এ জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে উৎপাদন খরচ কিভাবে কমানো যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d