বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারের চালচিত্র: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিপর্যয়
নিয়ন্ত্রণহীন বাজার তথা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে কাটলো ২০২৩ সাল। বিশেষত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে বছরজুড়েই সীমাহনী দুর্ভোগে পার করেছে মানুষ। নিকট অতীতের কোনো একক বছরে পণ্যমূল্যে এতটা অস্থিতিশীলতা দেখেনি দেশবাসী। ডলার সংকটের মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতিতে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল নাভিশ্বাস অবস্থা। সীমিত আয়ের মানুষ এমনকি মধ্যবিত্তরা পুরো বছরে সংসারের খাবার যোগাতে বিশেষত খাদ্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেয়েছে। অনেকে বাধ্য হয়ে খাওয়া-দাওয়া সীমিত করেছেন। খাদ্যপণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক পরিবার আকাশচুম্বী দামের কারণে বছরজুড়ে মাছ, গোশত, ডিম, দুধের চাহিদা মেটাতে পারেনি।
২০২৩ সালের শুরু তথা জানুয়ারি মাস থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বছরের শেষ ভাগে এসে তা আরো বেড়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কার্যত চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এতে করে বেপরোয়া হয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে উঠে যায়। যা ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের তিন মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘সিডিণ্ডকেটের হাত লম্বা। তারা খুবই পাওয়ারফুল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সরকারকে বিপদে পড়তে হবে।’ বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর ব্যবসায়ীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। বছর জুরে কখনো ডিমের সিণ্ডিকেট, কখনো পেঁয়াজ, কখনো ব্রয়লার মুরগি, কখনো আদা-রসুন, কখনো সয়াবিল তেল, কখনো চাল, কখনো আলু সিন্ডিকেট বেপরোয়া ভাবে দাম বৃদ্ধি করে।
মূলত বছরজুড়েই বাজারে জিনিসপত্রের দাম ছিল বেশ উর্ধ্বমুখি। কখনো ডিম, কখনো আবার পেঁয়াজ বা আলুর দাম বেড়েছে। শাক-সবজি, মাছ- গোশতের দামও ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে। এছাড়া তেল ডাল চিনি আটা ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দামও ছিল অস্বস্তির পর্যায়ে।
গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা তেমন একটা কাজে আসেনি। বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল, কিন্তু তার সুফল মেলেনি। এছাড়া বছরের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতায় নিম্নবিত্তের মানুষের উপার্জন কমেছে। এতে তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। সরকার সিটিবির পণ্য বিক্রি করেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার পরিষদ অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু পণ্যের দাম কমানো যায়নি।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যা সব শ্রেণির মানুষের জন্যই আতঙ্কের। বাজারে গিয়ে বছরজুড়ে কেউ স্বস্তি পায়নি। গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা তেমন একটা কাজে আসেনি। বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল, কিন্তু তার সুফল মেলেনি। এছাড়া বছরের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতায় নিম্নবিত্তের মানুষের উপার্জন কমেছে। এতে তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে।
বছর জুড়ে পণ্যের দাম কেজিতে একশ টাকা বেড়ে গেলে সরকারের চাপাচােিত কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমেছে। গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। তবে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই দীর্ঘ। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নিয়মিত বাজার দরের হিসাব রাখে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল ও আটা-ময়দার দাম কমেছে। অন্যদিকে ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, আলু, ডিমসহ মসলা, মাছ, গোশতের দাম বেড়েছে। বছরের শেষ দিকে গরুর গোশতের দাম কমে গেলেও সিন্ডিকেট নতুন করে দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বছরজুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা দুরবস্থা সৃষ্টি করেছে। বছরের শুরুতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামবৃদ্ধি, ডলারের ঘাটতি, পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে ডলার সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ বেশকিছু কারণে দ্রব্যমূল্যের সরবরাহ সংকটও ছিল। তারপরও এ বছর গম, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু ডলার সংকট এবং জ্বালানির দাম বাড়ায় উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকেরা পণ্যের দাম কমায়নি। এতে বাংলাদেশে ওই সব পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে।
বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা বরং বছরজুড়ে ওইসব নানা সমস্যাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে যতটুকু দাম বাড়ার কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ দাম বাড়িয়ে অবৈধ মুনাফা লুটেছে অতি মুনাফালোভীরা।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা।
এমন পরিস্থিতেতে সারাবছর প্রশ্ন উঠেছে, ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট কি বেশি শক্তিশালী? এরপর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ‘অসহায়ত্ব’ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকার। এমনকি বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকেও কয়েক দফা বাজার সিন্ডিকেট প্রতিরোধের তাগিদ দিতে হয়েছে।
অবশ্য লাগামছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণে চলতি বছর সরকার বেশকিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেয়। এরমধ্যে চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আলু, ডিম অন্যতম। তবে বাজারে কোনো পণ্যই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি। এখনো সেগুলো নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু ডিমের দাম কমেছে।
যদিও বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে বছরজুড়ে তৎপরতা দেখা গেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। প্রতিদিন সারাদেশে শত শত প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে জরিমানা করলেও পরক্ষণেই একই পণ্য বিক্রি হয়েছে বাড়তি দামে।
নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়ে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পেছনে ছুটেছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ। খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য কিনতে শুরুর মতো বছরের শেষ ভাগেও মানুষের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ছে। চাহিদার চেয়ে বরাদ্দ কম থাকায় অনেকে ওএমএসের চাল-আটা বা টিসিবির পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। তবে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে বছরের শেষ ভাগে সরকার ফ্যামিলি কার্ডধারীদের পাশাপাশি আগের মতো আবারও টিসিবির ট্রাকসেল চালু করেছে। যদিও সে কার্যক্রমও চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। জানতে চাইলে ভোক্তা-অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজারে যা হচ্ছে তাকে ব্যবসা বলা যাবে না। ভোক্তাকে জিম্মি করে ডাকাতি চলছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। বাজারে সুশাসনের ঘাটতির কারণেই সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছেন, সরকারের কোনো বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেগুলো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর কিছু জরিমানা করছে। এতে ব্যবসায়ীদের টনক নড়ছে না। তাদের কিছু যায়-আসেও না।