বড় ঘাটতি সেবা বাণিজ্যে
আয়ের চেয়ে ব্যয় দ্বিগুণ, বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসায় ডলার খরচ বাড়ছে চাপ পড়ছে রিজার্ভে
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদেশিদের কাছে সেবা বিক্রি করে ৪ হাজার ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। অপরদিকে এ খাতে বিদেশ থেকে সেবা কিনতে গিয়ে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ২৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৩ হাজার ১৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সেবা খাতের এ বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট, ইসরায়েল-গাজা সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাকে অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী করলেও ভ্রমণ, চিকিৎসা ও বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় ব্যয় সেবাখাতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সংশ্লিষ্টরা জানান, উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর সেবা খাত থেকে প্রচুর আয় করলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। সেবা রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আয় করে, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় করে সেবা আমদানির ক্ষেত্রে।
সেবা রপ্তানির তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে পরিবহন, ভ্রমণ (পর্যটন), ব্যাংক-বিমা, টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি। বিদেশি বিমান, জাহাজ কিংবা অন্যান্য পরিবহন বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি নিলে, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি মিশন ও দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে ডলারে আয় করলে, বাংলাদেশে সমুদ্র ও বিমান পরিবহন বাবদ চার্টার ফি, পর্যটক এবং বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে যে ডলার ব্যয় করে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পে নিয়োজিত বিদেশি ঠিকাদার কোম্পানির কাছে যে পণ্য ও সেবা বিক্রি হয় এসব কিছুই সেবাখাতের রপ্তানি আয় হিসেবে ধরা হয়। এ ছাড়া আইসিটি খাতে সফটওয়্যার, ডাটা প্রসেসিং, হোস্টিং সার্ভিস ও কম্পিউটার সেবা বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং বাবদ আয় এবং বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বিদেশে কনসালটিং সেবা দিয়ে আয় করলে সেটিও সেবা খাতে রপ্তানি আয় হিসেবে ধরা হয়।
এর বিপরীতে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোর ব্যয়, বাংলাদেশি পরিবহন বিশেষ করে বিমান, জাহাজ বিদেশে জ্বালানি ও বন্দর সুবিধাসহ অন্যান্য সেবা বাবদ ব্যয়, বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়, আইসিটি বা কম্পিউটার সার্ভিসেস আমদানি ব্যয়সহ বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ভিন্ন দেশ থেকে যে কোনো ধরনের সেবার বিনিময়ে পরিশোধিত অর্থকে এ খাতের ব্যয় হিসেবে ধরা হয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেবা খাতে মোট আয়ের মধ্যে পরিবহন খাত থেকে ৫৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভ্রমণ বাবদ ২৯৭ মিলিয়ন ডলার, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি থেকে ৪২৩ মিলিয়ন ডলার, অন্যান্য ব্যবসায়িক সেবা থেকে ৭৪৯ মিলিয়ন ডলার, সরকারি সেবা বাবদ ১০৬০ মিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য খাতে ৯৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় এসেছে।
বিপরীতে বাংলাদেশকে পরিবহন বাবদ ৪ হাজার ৫৮৫ মিলিয়ন ডলার, ভ্রমণ বাবদ ১ হাজার ৫১ মিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য সেবা বাবদ ৮৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পরিবহন ও ভ্রমণ সেবা খাতে বাংলাদেশের আয়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। এই ঘাটতি কমাতে আইসিটি ও সফটওয়্যার খাতে দক্ষতা বাড়ানো, বাণিজ্য বাধা দূরীকরণ ও সেবার গুণগত মানোন্নয়ন এবং পর্যটন বিকাশকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। এর ফলে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে ভ্রমণ, বিদেশে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ ও উচ্চশিক্ষায় ব্যয় বেড়েছে। এসব খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে শুধু সেবা খাতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে তাই নয়, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও বিদেশে চলে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ পর্যটন খাতে সেবার গুণগত মান বাড়িয়ে এ খাতে ডলার খরচ কমানো যেতে পারে।