Trending

বন্ধ ভারতীয় ভিসা: বিপাকে বাংলাদেশি রোগীরা, বেশি খরচে বিকল্প গন্তব্যে যেতে হচ্ছে

বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ থেকে ২১ লাখ রুপির ব্যবসা কম হচ্ছে। বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশি রোগীরাও।

ভারত-বাংলাদেশের চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে একেবারে গুরুতর রোগী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশিকে মেডিকেল ভিসা দিচ্ছে না ভারত। ভিসা না পাওয়ার কারণে প্রতিবেশী দেশটিতে নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা ফলোআপে যেতে না পেরে বিপাকে পড়েছে সাধারণ রোগীরা। 

ফলে চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশি রোগী। তবে অনেকেরই এই দেশগুলোতে চিকিৎসার খরচ ও ভ্রমণ ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নেই।

ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। এতে ভারতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে তাদের বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ড. শফিউন নাহিন শিমুল বলেন, এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে রেফারেল সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থায় রোগীদের সঠিক ডাক্তার বা হাসপাতালের কাছে পাঠানো হবে এবং ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা আরও সংগঠিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ডাক্তাররা খারাপ, কেউ বলে না। কিন্তু যোগাযোগে ঘাটতি আছে। রোগীরা কেন বিদেশে যায়, সে বিষয়ে ভালো গবেষণা করে আমাদের চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করতে হবে।’

ভারতে কমছে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালের বাংলাদেশ প্রতিনিধি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ভিসা প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয় ভারত সরকার। 

ওই প্রতিনিধি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের বেঙ্গালুরু ব্রাঞ্চে প্রতি মাসে ৪০০-র বেশি নতুন রোগী যেত। কিন্তু গত মাসে সেখানে ১০০ নতুন রোগী গেছে। আমাদের কলকাতার দুটি ব্রাঞ্চে মাসে গড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ রোগী যেত; সেখানে নভেম্বর মাসে ১৫০ থেকে ২৫০ জন রোগী গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে ভয়ে যাচ্ছে না। আমার একজন রোগীর মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) অপারেশন ছিল কলকাতার একটি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি সেদিন সকালে আমাকে জানিয়েছেন, যাবেন না; এই পরিস্থিতিতে ভারতে যেতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। অপারেশন থিয়েটার, ডাক্তার রেডি; কিন্তু রোগী যায় নাই।’ 

ওই হাসপাতাল প্রতিনিধি আরও জানান, যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো—অর্থাৎ সেসব রোগী চিকিৎসার জন্য আগে দিল্লিতে যেত, সেই রোগীরাই এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তুরস্কে যাচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘এই মাসে আমরা দুইজন রোগীর মৃত্যুর খবর পেয়েছি। যাদের গত মাসে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল ফলোআপের জন্য, কিন্তু ভিসা সমস্যার কারণে যেতে পারেনি। ক্যান্সার রোগীরা কেমোথেরাপি দেওয়ার পর তিন থেকে ছয় মাসের জন্য দেশে আসে। ওইসব রোগীর এখন ফলোআপে যেতে পারছে না।’ 

ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) বছর দুয়েক ধরে লিভারের ক্ষত ও ইনফেকশনজনিত সমস্যায় ভুগছেন। দেশের বেশ কয়েক জায়গায় ডাক্তার দেখিয়েও লিভারের চিকিৎসায় কোনো অগ্রগতি না হয়ে বরং অবস্থার আরও অবনতি হতে শুরু করে। ফলে তিনি ভারতের চিকিৎসার দিকে ঝোঁকেন। 

গত বছর থেকে হায়দ্রাবাদের এআইজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন তিনি ইয়াসমিন। চিকিৎসা শুরুর পর তার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়; কিন্তু তিন মাস পরপর হায়দ্রাবাদে গিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তার দেখাতে হয়। রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে রোগীর ওষুধপথ্য বদলে দেন চিকিৎসক। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় চেকআপের নির্ধারিত তারিখ থেকে চার মাস পার হয়ে গেলেও ডাক্তার দেখাতে যেতে পারছেন না তিনি। এর ফলে তার শারীরিক অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশি রোগীরা সাধারণত ট্রান্সপ্লান্ট, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, অর্থোপেডিকস ও অনকোলজির মতো চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। 

বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ থেকে ২১ লাখ রুপির ব্যবসা কম হচ্ছে বলে ভারতীয় পত্রিকা ‘এই সময়’-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কলকাতার চিকিৎসকদের আশ্বাস

এদিকে কলকাতার হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পিয়ারলেস হাসপাতালের সিইও সুদীপ্ত মিত্র টাইমস অভ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের সঙ্গে বৈষম্য করব না।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল অভ কার্ডিয়াক সায়েন্সেসের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ড. দীপক শংকর রায় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা দৈনিক ২০ জন থেকে কমে ৫ জনে নেমে এসেছে। তবে হাসপাতালের নীতির কারণে এ সংখ্যা কমেনি।

তিনি বলেন, ‘ভিসা ও ভ্রমণ জটিলতার কারণে কম রোগী আসছেন। ডাক্তার হিসেবে আমরা রোগীদের সমাজ, ধর্ম বা জাতীয়তা দেখি না। আমাদের কাছে সবাই সমান। আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা আমরা অব্যাহত রাখব।’

ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) পশ্চিমবঙ্গ শাখার চিকিৎসকেরা বুধবার (৪ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভিসা জটিলতায় অনলাইনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি রোগীদের। এমনকি মেডিকেল ভিসার জন্য অনেককে সার্টিফিকেটও দিচ্ছেন তারা। শিগগিরই একটি হেল্পলাইন চালুর ঘোষণাও দেন আইএমএর নেতারা।

বিকল্প চিকিৎসা গন্তব্যে ঝুঁকছে রোগীরা

ট্রিপ মেকারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী হাসানুজ্জামান রনি টিবিএসকে বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে ভারতের কোনো রোগী আসছে না—একেবারে জিরো। আগে প্রতি মাসে অন্তত ১০-১৫ জন ভারতের রোগী থাকত। এখন গুরুতর রোগীরা থাইল্যান্ড যাচ্ছে, আগে যারা মূলত ভারতে যেত। গত মাসে থাইল্যান্ডে ১১ জন রোগী গেছে, তার মধ্যে ৮ জন নতুন রোগী।’ 

এছাড়া বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে চিকিৎসা পর্যটনের প্রবাহ মালয়েশিয়ার দিকে সরছে। ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর ওয়ার্ল্ড-এর তথ্য অনুযায়ী, সাশ্রয়ী এবং উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ায় বাংলাদেশি রোগীদের মধ্যে মালয়েশিয়ার চিকিৎসা পর্যটন খাতের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এর বড় সুফল পাচ্ছে দেশটির চিকিৎসা পর্যটন শিল্প।

ব্যাংককভিত্তিক মেডিকেল ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুয়া নোই ফিট অ্যান্ড ফ্লাই-এর ম্যানেজার মাজেদুল নয়ন টিবিএসকে জানান, তাদের কাছে এখন চার মাস আগের তুলনায় ২০০ শতাংশ বেশি ফোনকল ও মেসেজ আসছে। ‘৮০ শতাংশের বেশি রোগী বলছেন, তাদের ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে যেতে পারেননি। তাই তারা থাইল্যান্ডে আসতে চান।’ 

তবে তিনি অনেক রোগীর জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘থাইল্যান্ডে চিকিৎসার খরচ ভারত বা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, বিদেশিদের জন্য খরচও বেশি। থাইল্যান্ডে দীর্ঘ সময় থাকা ব্যয়বহুল।’ 

তিনি আরও জানান, যারা ভারতের বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ডে যাওয়ার কথা ভাবেন, তাদের ৮০ শতাংশের বেশি খরচ বহন করতে না পেরে যথাযথ চিকিৎসা পান না। 

চৌধুরী হাসানুজ্জামান রনি বলেন, থাইল্যান্ডে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমানভাড়া একটি বড় সমস্যা। ‘আগে রোগীরা বাস বা ট্রেনে করে ভারতে যেতে পারতেন। থাইল্যান্ডে চিকিৎসার খরচ ভারতের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ বেশি। তাই শুধু সামর্থ্যবানরাই থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন। ‘

ড. শফিউন নাহিন শিমুল বলেন, ‘এখন এই পরিস্থিতিতের ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আলোচনা করতে পারে। কারণ, মূলত একেবারে সাধারণ রোগীরাই ভারতে যায়। যাদের টাকা আছে, তারা আগেও থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিত; ভারতে যেত না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া শ্রীলংকাও ভারতের বিকল্প হতে পারে। শ্রীলংকার চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো এবং খরচও কম। সরকার এভারকেয়ার, ইউনাইটেডের মতো বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, যাতে দরিদ্র রোগীরাও চিকিৎসা নিতে পারে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button