Bangladesh

বাংলাদেশকে বৈদেশিক নীতির উদাহরণ বানাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র: কুগেলম্যান

বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই আগ্রহী এবং সজাগ। বাংলাদেশকে নিজের মূল্যবোধভিত্তিক বৈদেশিক নীতির উদাহরণ বানাতে চায় দেশটি। এক্ষেত্রে সফল হবে বলেও আশাবাদী। গণতন্ত্র সম্মেলনের মতো মর্যাদাকর সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো একটি সিগন্যাল। সমপ্রতি দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। আজ থেকে দেড় বছর আগে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এখন সকলেই সেটি প্রত্যক্ষ করছেন।

অদূর ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বললেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে খুবই আগ্রহী এবং সজাগ। এখানকার আগের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে ওয়াশিংটন মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে সত্যিকারভাবেই গণতন্ত্রের অবস্থা ও মানবাধিকারের মূল সূচক হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে আসলেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে তাই যদি নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনকে যদি যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু বলে মনে না করে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সেটির প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে তা উৎসাহিত করতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে, সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশের নির্বাচন অতি গুরুত্বপূর্ণ।

পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসে কুগেলম্যান নিজেই প্রশ্ন করলেন, কেন বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ? উত্তরও দিলেন নিজেই- আসলে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। যে কারণে র?্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অনুরূপ, নির্বাচনী পরিবেশ এবং রাজনৈতিক পরিবেশের ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি উদাহরণ বানাতে চায়। নিজের মূল্যবোধভিত্তিক বৈদেশিক নীতির উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখতে চায়। আসলে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। সারা দুনিয়ায় বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে শক্তিশালী দেখতে চায়। বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহের আরেকটি কারণ হতে পারে, দেশটি মনে করে বাংলাদেশে এক্ষেত্রে তারা সফল হবে।

অনেক দেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে কম সোচ্চার হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম কেন সেটিও ব্যাখ্যা করলেন এই প্রথম ঢাকা সফরে আসা কুগেলম্যান। বললেন- ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগতভাবে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুকে বেশি ব্যবহার করে তবে তা নিজের কৌশলগত স্বার্থে প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেটির অতোটা (ভারতের মতো) গভীর কৌশলগত গুরুত্ব নেই। তাই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন মনে করে, র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপগুলো গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যা কমাতে আসলেই কাজ করে। বাংলাদেশের আগে ‘ভিসা পলিসি’ও হাতেগোনা মাত্র দু-তিনটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানে সরকারি দলের সহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের পরিবার-পরিজনই যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন। ভিসা পলিসি’র ফলে তাদের এবং তাদের পরিবার ভাবতে পারে যে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে যুক্তরাষ্ট্র যেতে বাধা পাবো। তাই, ওয়াশিংটন হয়তো মনে করে যে, অন্য দেশে কাজ না করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উক্ত ভিসা পলিসি কাজে দেবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে কুগেলম্যান বলেন, আমি নিশ্চিত নই, তবে অবাক হবো না যদি যুক্তরাষ্ট্র বলে- বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইলে জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়া হবে; যে সুবিধা প্রায় এক বছর ধরে দেয়া হচ্ছে না। গণতন্ত্র সম্মেলনের মতো মর্যাদাকর সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোটা একটা সিগন্যাল যে, যতদিন সবকিছু সঠিক পথে না আসছে আমরা তোমাদের এখানে ডাকছি না।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুগেলম্যান তাকিয়ে রয়েছেন বিএনপি’র একটি সিদ্ধান্তের দিকে। বললেন, বাইরের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে- ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধীদের দাবি মেনে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পথ করে দেবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না ফিরলে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করবে কিনা এটাই বড় প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বয়কট করলে যুক্তরাষ্ট্র সহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করবে কিনা সেটিও দেখার বিষয়। বিএনপি কতোদিন আন্দোলন করে এভাবে সরকারকে চাপ দিতে থাকবে, তত্ত্বাবধায়কের দাবি পূরণ না হলে বিএনপি কী করবে তার উপরই নির্ভর করবে আসছে দিনে বাংলাদেশ কোথায় যাবে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক কুগেলম্যান- অনেক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ল্যান্সে এ অঞ্চলকে দেখে আসছিল- আফগানিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করা, পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা (যেটি আফগানিস্তান যুদ্ধের সঙ্গেই যুক্ত) এবং ভারতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা। কিন্তু, বাংলাদেশ সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া সেভাবে ওয়াশিংটনের কৌশলগত আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল না। কিন্তু, এখন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের দুই বছর পর দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন ল্যান্সে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলকে দেখতে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতাকে মাথায় রাখছে। যেমনঃ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা। 

স্পষ্টতই, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের অর্থাৎ সার্কভুক্ত সকল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চাচ্ছে, উচ্চ পর্যায়ে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে যেন দেশগুলো অর্থনৈতিক সাহায্য লাভে পুরোপুরিভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে। কিন্তু, কেবল বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ল্যান্সে না দেখে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি সহ অন্যান্য বিভিন্ন ল্যান্সে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

জামায়াত সহ ইসলামপন্থি বিরোধী দলগুলো সহজাতভাবে সহিংস গোষ্ঠী নয় বলে মন্তব্য করে কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলে ইসলামিক স্টেটের প্রভাব রয়েছে। সরাসরি না থাকলেও অনেক সহিংস গোষ্ঠী তাদের দ্বারা উৎসাহিত। হলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বড় কোনো হুমকি দেখা যায় নি। এটা সত্য যে, সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক ক্র্যাকডাউন চালানো হয়েছে, যার কার্যকারিতাও দেখা গেছে। কিন্তু, ভয়াবহ হলো সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত ক্র্যাকডাউন চালালে এমন ঝুঁকিও থাকে যে, সরকার এই অজুহাতে বিরোধী ইসলামপন্থি দলগুলোর (যেমনঃ জামায়াত), এমনকি বিএনপি’র বিরুদ্ধেও ক্র্যাকডাউন চালাতে পারে। এভাবে, সরকারবিরোধী দলকে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আখ্যা দেয়া যেতে পারে, যেটা খুবই বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের জন্য যা ভয়াবহ।

সমপ্রতি অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে ছয়টি দেশকে উক্ত জোটে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে- সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিশর এবং ইথিওপিয়া। এর ফলে ভারতই বেশি লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন কুগেলম্যান। যে ছয়টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে তাদের একটি ছাড়া কেউই পশ্চিমা বিরোধী নয়। এটা ভারতের জন্য ভালো কারণ। দেশটি চায় না এমন কোনো কিছুতে যোগ দিতে যাকে পশ্চিমা বিরোধী বলে মনে করা হয়। নতুন সদস্যদের অনেকেই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর। তাছাড়া, নতুন সদস্যদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেগুলো জ্বালানি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কুগেলম্যান বলছিলেন, রোহিঙ্গারা ছয় বছর আগে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। সেখানকার পরিস্থিতি তখনকার চাইতে এখন আরও বেশি খারাপ। ঢাকা সত্যিই এক বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতার জন্য মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে এমন দেশগুলো যেমন: চীন, ভারত এমনকি রাশিয়ারও সাহায্য চাইতে পারে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের গতি বাড়াতে সরকার অভ্যন্তরীণভাবে চাপের মুখে থাকলেও মিয়ানমারে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বিষয়টি সহজ নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button