Trending

বাংলাদেশের ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’, নাকি ভারতের ‘পরিপক্কতা’?

বাংলাদেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো দাবি করছে, ভারতের সাথে আলোচনায় নিজেদের দাবি বা স্বার্থ আদায়ে কূটনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছে না বাংলাদেশ। তারা মনে করেন, এ কারণেই ভারত তার চাওয়াগুলো আদায় করতে পারলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বিরোধী নেতারা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি হওয়া ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির’ কারণেই আলোচনার টেবিলে শক্তভাবে কথা বলতে পারছে না বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

‘ভারতীয়দের সামনে সরকার দুর্বল বলেই কূটনীতিকরা কাজ করতে পারে না। আর সে কারণেই ভারত তার ইচ্ছেমতো সব কিছু পাচ্ছে,’ বলছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এ কে আবদুল মোমেন অবশ্য বলছেন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা নেই, তবে ব্রিটিশদের হাতে তৈরি ভারতীয় আমলাতন্ত্র ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পুষ্ট এবং অনেক পরিপক্ব’।

‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেকটাই ভিন্ন। এখানে দুই প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড়। তাদের মধ্যে ক্যারিশম্যাটিক একটি সম্পর্ক থাকায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কম। এজন্যই স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো কঠিন কাজ বাস্তবায়ন করা গেছে। এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এসেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন, পলিসি লাইন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসে এবং কূটনীতিকরা সেটিকে বাস্তবায়নে কাজ করেন।

‘সেক্ষেত্রে রাজনীতিকরা যতটুকু স্পেস দেন, কূটনীতিকরা সেটুকুই প্রয়োগ করতে পারেন। তবে কূটনীতিকদের পেশাগত মতামত ও রাজনৈতিক নেতাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনার সমন্বয় হলে আলোচনার টেবিলে শক্ত অবস্থান তৈরি করা যায়।’

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের মধ্যে দশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সামাজিক মাধ্যমে রেল ট্রানজিটসহ কিছু বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার।

বক্তৃতা বিবৃতিতে অনেকেই অভিযোগ করছেন যে- দ্বিপক্ষীয় আলোচনাগুলোতে বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছেন না।

সক্ষমতা নিয়ে যত আলোচনা
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সম্পাদিত চুক্তিগুলোয় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

‘সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে ভারতের কাছ থেকে দাবিগুলো আদায় করে নিয়ে আসতে। পানির হিস্যার মীমাংসা না করেই তিনি চুক্তিতে সই করতে চাইছে। পানি সবচেয়ে আগে দরকার। সেটা না করেই তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে,’ বলেছেন তিনি।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে কাজ করছে তার সরকার। তিনি এও বলেছেন, ভারতকে রেল ট্রানজিট দেয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না এবং দেশের মানুষের কল্যাণের কথা মাথায় রেখেই ভারতের সাথে রেল যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে।

তবে এসব বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এই বলে সমালোচনা করছেন যে- দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ, অর্থাৎ বাংলাদেশের কূটনীতিক অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের সক্ষমতার ঘাটতিও এখানে বড় সঙ্কট হিসেবে মনে হচ্ছে অনেকের কাছে।

‘আমলা বা কূটনীতিকরা পারছে না। তবে এজন্য সরকারই দায়ী। তারা ভারতকে সব দিয়ে বসে থাকলে আমলাদের করণীয়ই বা কী থাকে,’ বলছিলেন আসাদুজ্জামান রিপন। তবে তার মতে, ভারতীয় ফরেন সার্ভিসসহ আমলাতন্ত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবীদের গুরুত্ব দেয়ার বিপরীতে বাংলাদেশে দলীয় অনুসারীদের নিয়োগের প্রবণতাও আমলাতন্ত্রের দুর্বলতার বড় কারণ।

এখানে বলে রাখা ভালো, সাধারণত কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক প্রধান পর্যায়ে যাওয়ার আগে উভয় দেশের কর্মকর্তারা তা নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেন। তারা নিজ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনা নিয়ে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করার কথা।

যদিও সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেভাবেই দেখা হোক না কেন বাংলাদেশের দিক থেকে এটিকে সবসময় রাজনৈতিক বিবেচনা ও গভীরতা থেকে দেখা হয়।

‘সব সরকারের আমলেই ভারতের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিক থেকেই আসে। তা ভালো-মন্দ যাই হোক,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ভারতের সাথে বড় দাগে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে সেগুলোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতা বা সরকার সমর্থকরা সবসময় প্রধানমন্ত্রীকেই কৃতিত্ব দেন, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি।

তবে এবার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় রেল চলাচলের জন্য রেল ট্রানজিট, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ এবং রংপুরে কনস্যুলেট খুলতে দিতে রাজি হওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।

সমালোচনাকারীদের অনেকে মনে করেন, আলোচনার টেবিলে শক্তভাবে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার মতো কূটনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই বা তৈরি হয়নি।

‘তিস্তার পানি আনতে পারেনি। অথচ সরকার তাদের তিস্তা মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হবার সুযোগ দিয়েছে। এটা কোনো দক্ষ আমলাতন্ত্রের কাজ হতে পারে না। এটা হয়েছে কারণ সরকারের ভারত তোষণ নীতির বিপরীতে গিয়ে পেশাগত অবস্থান তুলে ধরার মতো পরিবেশটাই নেই,’ বলছিলেন আসাদুজ্জামান রিপন।

হুমায়ুন কবির মনে করেন কূটনীতিকদের দক্ষতা দেখানো নির্ভর করে তাদের কাজের স্বাধীনতা কতটা আছে এবং তাদের মতামত কতটা গৃহীত হয় কিংবা তাদের অবস্থান কতটা সমর্থন পায় তার ওপর।

‘সামগ্রিকভাবে কূটনীতির ভিত্তি হলো নীতি নির্ধারণী পর্যায়, সরকার প্রধান যেখানে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। সেখানে আবেগের চেয়ে পেশাগত উপলব্ধি, গভীরতা ও নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ,’ বলছিলেন তিনি।

যদিও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিল্লিকে প্রভাবিত করে এমন শক্তিগুলোকে মবিলাইজ করে চাপ তৈরির মতো গভীরতা সম্পন্ন কূটনৈতিক দক্ষতা সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের তৈরি হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোর শক্তি বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারছে না এই ঘাটতি কারণেই, বলছিলেন একজন বিশ্লেষক।

‘গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে জ্যোতিবসুর ভূমিকার কথা সরকার নিজেই বলে। কিন্তু এখন সেটি হচ্ছে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটাই কূটনীতি কিংবা রাজনৈতিক কূটনীতির ঘাটতি,’ বলছিলেন তিনি। তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

‘আবার রংপুরে ভারতকে কনস্যুলার খুলতে দেয়ার মানে হলো বুদ্ধির খেলায় হেরে গেছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। তিস্তায় চীন আসতে চাইছে বলেই ভারত এটি বাংলাদেশ থেকে আদায় করে নিয়েছে। কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এটি নাও হতে পারতো,’ বলছিলেন তিনি।

‘রাজনৈতিক সমাধানে ভারতই উৎসাহী’
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বিভিন্ন সময়ের চুক্তি বা প্রধানমন্ত্রীর সফরে এবার হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলো নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন তারা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেই সেটি করছেন।

‘মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বহুমাত্রিক। দুই দেশের বড় সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হয়েছে। আর ভারত বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানেই উদগ্রীব থাকে,’ বলেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলছেন, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা সরকারের সব দফতর থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য উপাত্ত অনেকক্ষেত্রেই সময়মতো পায় না।

‘ব্রিটিশের তৈরি আমলাতন্ত্র ভারতের। তাদের আমলাতন্ত্র অনেক পরিপক্ব। তারা অনেক সময় আলোচনায় কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। কারণ তাদের কাছে তথ্য ভালো থাকে। তারা হোমওয়ার্ক ভালো করে। এসব বিষয়ে ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের কিছুটা দুর্বলতা থাকে। তবে এটাকে কূটনৈতিক দুর্বলতা বলা যাবে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d