বাংলাদেশের স্বপ্নের ৯০ দিন, মার্কিন বাজার ধরে রাখতে ‘পরিকল্পনা মিশন’ নিয়ে নামতে হবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্রাম্প বিশ্বের ১৪২টি দেশের পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছিলেন। পরে চীন ব্যতীত অন্য দেশগুলোর ৯০ দিনের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ স্থগিত করেছেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের দেশগুলো তাদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অতিরিক্ত শুল্কারোপ কমানোর লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেকটা পিছিয়ে। দেশের তৈরী পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র্। কাজেই ওই দেশে পণ্যের প্রবেশে যাতে বিশেষ সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে পরিকল্পিত মিশন নিয়ে নামতে হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা ড. ইউনূসের ওপর সব দায়িত্ব দিয়েই যেন পার পেতে চাচ্ছেন। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে কথামালার ঢেউ তুলছেন। কাজের কাজ কিছুই করছেন না। মনে রাখতে হবে বিশ্ব এখন প্রতিযোগিতার বাজার। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত ও পাকিস্তান নানা পরিকল্পনার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা চীনের বাজারকে ধরতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোমধ্যে। সময় থাকতেই সরকারকেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী, সাবেক ঝানু আমলা, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ব্যবসায় অভিজ্ঞ প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে কমিশন বা বিশেষ মিশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টির চেষ্টায় তৎপরতা চালাতে হবে। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। বিশ্বের বহু দেশ ৯০ দিন সুযোগ কাজে লাগিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে ইতোমধ্যেই বোঝানো শুরু করেছে। পাশাপাশি ওই দেশগুলো নতুন বাজারের সন্ধান করছে।
এ বিষয়ে এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ৯০ দিনের সময়সীমা যেন আত্মতুষ্টির কারণ না হয়। এখনই জানাতে হবে বাংলাদেশ কী করছে। কারণ মৌসুমভিত্তিক পণ্য রফতানির জন্য সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমদানি শুল্ক পদ্ধতি এবং অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ক-কর, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা দীর্ঘদিন থেকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও এখনো কিছু ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধে অসহযোগিতা করছে। বিশেষ করে আমদানির বিপরীতে বিল সময়মতো পরিশোধ করছে না। যে কারণে এলসির অভাবে কাঁচামালও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে আমদানির বিপরীতে বিল সময়মতো পরিশোধ না করা হলে একদিকে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং অনুকূল বাণিজ্য পরিবেশ ব্যাহত করছে। যদিও এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই গত ৬ থেকে ১০ এপ্রিল দেশে সরকার বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে আসা বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগবিষয়ক দপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশের ইপিজেডসহ বিভিন্ন বিনিয়োগ সাইটও ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এতে প্রায় ৪০টি দেশের ৪৫০ জন বিনিয়োগকারী অংশ নেন। আয়োজক বিডা বলছে, এটি সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একটি পাইপলাইন তৈরি হবে।
তাদের মতে, সাধারণত একটি বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখতে ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে ভালো অঙ্কের বিনিয়োগ পাচ্ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত কয়েক মাস আগেই বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। যদিও এতে পরিবর্তনও এসেছে অনেকটা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অতিরিক্ত এলসি পেমেন্ট বিল ৮৮ মিলিয়ন ডলারে নিচে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৪ সালের নভেম্বরেও ছিল ৪৪৫ মিলিয়ন ডলারের ওপরে। এদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ নিলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশে দেশে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ ৯০ দিন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত ও পাকিস্তান নানা পরিকল্পনার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা চীনের বাজারকে ধরতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোমধ্যে। ওই সব দেশের রফতানিকারকরা পরিকল্পনা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। পাশাপাশি ওই দেশের সরকার এটাকে বড় সুযোগ দেখে নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও এই ৯০ দিনের সুযোগ নিয়ে আশাবাদী আমেরিকায় রফতানি আরও বাড়বে। তবে তারা বলছেন, সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের ওপর। সরকার এই সময়কে কিভাবে কাজে লাগাবে বা পরিকল্পনা নেবে তার ওপর।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ইনকিলাবকে বলেন, ৯০ দিনের বিরতি বাংলাদেশকে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। তার মতে, চীন শুল্কের মুখে পড়ায় আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে। এতে আলোচনার সুযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকারকে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পোশাক রফতানির বিষয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, রফতানি বাড়ছে, এই সুযোগে আরও বাড়বে। যদিও তিনি স্বীকার করেন এ নিয়ে পৃথক পরিকল্পনা তাদের নেই। এদিকে এখনও অভিযোগ আছেÑ কিছু ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপ। ঋণপত্র খুলতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এমন তালিকার বেশির ভাগ ব্যাংকই দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংক। বিশেষ করে এতদিন ব্যাংকিং খাতের লুটেরা বা মাফিয়া হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোই বেশি, যা আগামীদিনে দেশের নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে। সবমিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে পড়তে পারে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতোমধ্যে নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ। পুরনো শিল্পগুলো উৎপাদন বাড়াতে চাইলে তাদের অতিরিক্তের জন্য ৩৩ শতাংশ বেশি মূল্য দিয়ে গ্যাস ক্রয় করতে হবে, যা রফতানির এই সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষিত গ্যাসের নতুন মূল্যহারকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি –ফিকি। সংগঠনটি বৈষম্যমূলক মূল্যহার অতিসত্বর পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (ইউরোচ্যাম) নতুন ঘোষিত গ্যাসের দাম বৈষম্যমূলক, অন্যায় এবং বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারাও দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকলেও এ সময়কে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে কাজে লাগাতে সরকারকেও অধিক তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সময়ে ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে বলেও উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকের মতে, বড়দিনের আগে অর্ডার পেতে এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যথায় বিপদে পড়বে রফতানি খাত। তৈরী পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একটি হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখন থেকে ২ ডলারের একটি কটন টি-শার্ট চীন থেকে আমদানি হলে মোট শুল্ক দিতে হবে ২ দশমিক ৮৩ ডলার। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ থেকে একই টি-শার্ট রফতানি হলে শুল্ক দিতে হবে শূন্য দশমিক ৫৩ ডলার। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা দ্রুত শেষ হচ্ছে না। উচ্চ শুল্কের কারণে চীনের ক্রয়াদেশ সরবে। কারখানাও স্থানান্তরিত হবে। চীনের হারানো ব্যবসা নিতে বাংলাদেশকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত এটা বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সরকারকে এই সময়কে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। একই সঙ্গে এই নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার দাবি জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক মাস আগেই ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে। কারণ এ ধরনের অপরিশোধিত ঋণপত্র দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভাবমর্যাদা নষ্ট করে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং বাণিজ্য পরিবেশকে ব্যাহত করে। তাই, বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত পাঁচ মাস ধরে কয়েকবার একই ধরনের নির্দেশনা জারি করার পর গত রোববার জারি করা এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল ব্যাংককে একই নির্দেশ পুনর্ব্যক্ত করেছে।
গত বছরের নভেম্বরে ৪৪৫ মিলিয়ন ডলারের উপরে থাকা অতিরিক্ত এলসি পেমেন্ট ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কমে ২৪২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে তা ৮৮ বিলিয়নে নেমেছে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, গভর্নরের নির্দেশ এবং প্রত্যক্ষ তদারকিতে এলসি পেমেন্টে ব্যাপক অগ্রগতি এসেছে। সবসময়ই বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি তদারকি করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, মামলার অধীনে থাকা কোনও বিল যদি পরিশোধযোগ্য না হয়, তাহলে সরবরাহকারীর ব্যাংককে সে অনুযায়ী অবহিত করতে হবে। বিলম্বিত গৃহীত বিলের মাসিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়, জমা দেওয়ার আগে তথ্য অনলাইন আমদানি পর্যবেক্ষণ সিস্টেমের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, অনুমোদিত ডিলার শাখায় জমা দেওয়া সমস্ত বিল, অসঙ্গতি (যদি থাকে) এবং পেমেন্টের তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং মাসিক ভিত্তিতে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠাতে হবে। এই নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। অপরদিকে আমদানি বিল আটকে রেখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের মতো রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচেষ্টা যাতে না হয় সেদিকটাও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।