বাংলাদেশ কি চীনের খপ্পরে পড়েছে: আলোচনায় কংগ্রেসম্যানদের প্রশ্ন
বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়েছে কি না জানতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা। তারা একই সাথে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা এবং চলমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ রয়েছে কি না তা-ও জানতে চেয়েছেন।
গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনায় এসব বিষয়ে জানতে চান যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কংগ্রেসম্যান এড কেইস এবং জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেসম্যান রিচার্ড ম্যাকরমিক। ড. মোমেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, কাজী নাবিল আহমেদ, মুহাম্মদ আলী আরাফাতসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এ সময় উপস্থিত ছিলেন। মধ্যাহ্নভোজে দুই কংগ্রেসম্যানের স্ত্রীরা অংশ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই কংগ্রেসম্যান সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তারা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেন। এরপর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আলোচনায় বসেন। কংগ্রেসম্যানরা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে আজ কক্সবাজার যাবেন।
কংগ্রেসম্যানদের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়েছে কি না তা মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য জানতে চেয়েছেন। তাদের কাছে বিভিন্ন লোকজন বলেছে, বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর জায়গা। এরা চীনের খপ্পরে পড়ে গেছে। চীনের গোলাম হয়ে গেছে। এখানে অশান্তি আর অশান্তি। পুলিশ সব লোকজনকে ধরে মেরে ফেলছে। এই ধরনের একটি ধারণায় তাদের ভয় রয়েছে। আমি বলেছি, এসব কোনোটিই সত্য নয়। আমরা চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ছি না। চীন থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ নিয়েছে, তা মোট ঋণের মাত্র এক শতাংশের মতো।
রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ড. মোমেন জানান, কংগ্রেসম্যানরা জানতে চেয়েছেন বিএনপির সাথে সমঝোতার কোনো পথ আছে কি না। আমরা বলেছি, বিএনপির দাবি সরকারের পদত্যাগ। এটাতে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। আমি প্রশ্ন রেখেছি, নির্বাচনের সময় তোমাদের দেশে কি সরকার পদত্যাগ করে? নিশ্চয়ই না। এমন দাবি থাকলে তোমরা কি আলোচনায় বসবে? তাই পদত্যাগের প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আমরা বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন করব।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা থাকলে সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন সম্ভব বলে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যতগুলো দল আছে সব দল যদি নির্বাচনে আসে, তারা যদি আন্তরিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিসংতামুক্ত পরিবেশে হবে, তবে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সহিংসতা ছাড়াই নির্বাচন সম্ভব। কেবল সরকার বা নির্বাচন কমিশন চাইলেই সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে ‘গ্যারান্টি’ দেয়া যায় না।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে- এ বিষয়ে কংগ্রেসম্যানরা আশ্বস্ত হয়েছেন কি না, জানতে চাইলে ড. মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, সেটি তাদের জিজ্ঞেস করুন। তবে আমরা বলেছি, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিজের তাগিদেই আমরা একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। এটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেছেন। আমরাও তা-ই চাই। কারণ আমরা জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় আছি। আমরা নির্বাচনমুখী দল, আওয়ামী লীগ সবসময় নির্বাচনে বিশ্বাস করে। নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করুক, সেটিই আমরা চাই। কে জিতবে না জিতবে, সেটি জনগণের ওপর নির্ভর করবে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি, বাংলাদেশের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনের মধ্যে ভোট দেয়ার আগ্রহ কম। আমাদের এখানে অধিকাংশ লোক ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের মতো এত লোক নির্বাচনে দাঁড়ায় না। এখানে একটা নির্বাচনে কয়েক শ’ লোক দাঁড়ায়। সেটি নিয়ে আমাদের অসুবিধা নেই। শুধু সব দলমতের লোকের আন্তরিকতা দরকার।
দুই কংগ্রেসম্যানের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, তারা রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের তাগিদ দিয়েছেন। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর আমাদের ২০ লাখ যুবক কাজের বাজারে যোগ হয়। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৬২ জন রোহিঙ্গা নিয়েছে। পারলে আরো রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাক।
বিকেলে মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গুলশানের বাসায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে মতবিনিময় করেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, নাহিম রাজ্জাক ও তামান্না নুসরাত। তিনজনই সংসদ সদস্য। অন্য দিকে বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী। জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলে ছিলেন তিন সংসদ সদস্য শেরিফা কাদের, রানা মোহাম্মদ সোহেল ও নাজমা আকতার।
সন্ধ্যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেন দুই কংগ্রেসম্যান। এ সময় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মানবাধিকারকর্মী ও নারীপক্ষের সম্পাদক শিরীন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল, দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম ও টিভি টকশো তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিল্লুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।