Bangladesh

বাংলাদেশ কেন একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে?

ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন দর্শকরা মাঠে খেলতে থাকা দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা কতো শতাংশ সেটা দেখতে পান। কখনও কখনও, শেষ কয়েক ওভারে ম্যাচের ফলাফল এতোটাই স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিজয়ী দলের জয়ের সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। বাংলাদেশে ওই একই রকম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ০৭ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনে দেশটি তার “নতুন” প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের কারণে এই নির্বাচনে শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগের (আ.লীগ) জয়ের সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশের বেশি। টাইম ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে সমালোচকরা নির্বাচনটিকে “রাজ্যাভিষেকের সমতুল্য” বলে আখ্যা দিয়েছেন।

অবশ্য এটাই প্রথম নয়। ১০৫ জন নোবেল বিজয়ী সহ প্রায় ২০০ জন বিশ্বনেতার এক চিঠি অনুসারে, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনে বৈধতার ঘাটতি ছিল, যেগুলোতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ জিতেছে।

দেশটির সবচেয়ে বড় বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের মিত্ররা নির্বাচন ‘বয়কট’ করার ডাক দিয়েছে। তবে, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে বয়কটের এই সিদ্ধান্ত বিএনপি’র নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়নি, সেটা বরং তৃণমূল থেকেই এসেছে। বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বহু মিটিংয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, কেবল বিএনপির নেতাকর্মীরা নন, জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতারাও আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন। তাহলে কেন প্রধান বিরোধী দল, এমনকি সরকার সমর্থক কিছু দলের তৃণমূল নেতারাও শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে (দেশটির) রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বোঝাটা অপরিহার্য।

অসাধু আম্পায়ার

বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে চারটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে পরিচিত  ‘টেকনোক্র্যাট’ নির্বাচনকালীন সরকার ছিল। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর তত্ত্বাবধানের জন্য ১৯৯৬ সালে এই ব্যবস্থাটি সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল।

কিন্তু, ওই ব্যবস্থাটি সংশোধনের প্রয়োজনের কথা বলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আওয়ামী লীগ সংসদে নিজেদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ব্যবস্থাটি বাতিল করে।

আর এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকটও জন্মলাভ করে।

ক্ষমতাসীন দলগুলো কর্তৃক আমলাতন্ত্রে রাজনীতিকরণের কারণে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক দেখিয়েছেন যে কিভাবে স্থানীয় পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের প্রার্থীদের পরাজিত করার জন্য জোট গঠন করে থাকে। তাছাড়া, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে সিনিয়র এবং জুনিয়র আমলাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা আমলাতন্ত্রের একটি পক্ষের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাতিত্বই প্রদর্শন করে।

নির্বাচনী দৌড়ে এই আমলারাই নিজ নিজ এলাকায় প্রিসাইডিং অফিসারে পরিণত হন৷ তাদের দেওয়া অসীম ক্ষমতার জন্য তারাই “নির্বাচনের দেবতা”। মনোনয়ন অনুমোদন করা থেকে শুরু করে ভোট গণনা পর্যন্ত সমস্ত কিছুর দায়িত্বে থাকা বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকা ওই আমলাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব যে কোনো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং তৃণমূল সেটা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি ভালো জানে।

টেকনিক্যালি নির্বাচন কমিশনারদেরই চূড়ান্ত বক্তব্য রাখার এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু, তাদের ভূমিকাও সমানভাবে সন্দেহজনক। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশন ২০২৩ সালের আগস্টে একেবারে ন্যূনতম জনউপস্থিতির দুটি কম পরিচিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধিত করেছিল, যদিও প্রায় এক ডজন ‘সিরিয়াস প্রতিযোগী’র আবেদন তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল।

এছাড়াও, নির্বাচন কমিশনের একজন  সচিবসহ সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপত্র কেনার নজির রয়েছে, যা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্বেরই লক্ষণ।

মন্দ জায়গায় বিনিয়োগ

অসাধু আম্পায়ারদের তদারকি করা এই ধরণের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মন্দ জায়গায় বিনিয়োগ করার মতো। একটি উদাহরণের মাধ্যমে এটি আরও কিছুটা স্পষ্ট করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ভোটার (২১২,০১২) ঝালকাঠি-১ আসনে বসবাস করেন। কমিশন ঘোষণা করেছে যে ভোটার প্রতি ব্যয় ১০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। এটা সুপরিচিত যে প্রার্থীদের দ্বারা প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ বৈধভাবে অনুমোদন থেকে অনেক বেশি। এমনকি যদি কোনো প্রার্থী নিয়ম মেনেও চলেন, তবে ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে এবং বোঝাতে তাদের প্রায় ২০,০০০ ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। পরিমাণটা নেহায়েত ছোট নয়।

কোন্ যুক্তিবাদী লোক এমন একটি নির্বাচনে এই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবেন যেখানে তারা জানেন যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রশাসন কাজ করবে এবং নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি?

বিকল দন্ডাদেশ

২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অনেক বিরোধী নেতাদের (বেশিরভাগই বিএনপি’র) মনোনয়নপত্র দাখিল করতে বাধা দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বা তাদের কারা হেফাজতে রাখা হয়েছে।

তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক প্রার্থী এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক প্রার্থী শেখ রবিউল আলম, ঢাকা-১৭ আসনের সাবেক প্রার্থী সাইফুল আলম নিরব, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক প্রার্থী হাবিব উন নবী খান সোহেল, খুলনা-৪ আসনের সাবেক প্রার্থী আজিজুল বারী হেলাল, নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান, পাবনা-৪ আসনের সাবেক প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব, টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক প্রার্থী সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু প্রমুখ।

বাংলাদেশে ২ বছরের বেশি সাজা হলে কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অযোগ্য হন। অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশিরভাগই পলাতক।

রিপোর্ট বলছে, কিছু ক্ষেত্রে বিচারক কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচারক এমনকি অনেক আগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদেরও শাস্তি দেন। এখানে একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন হল, সরকার কি আদৌ চেয়েছিল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক? উত্তরটি স্পষ্টভাবেই না বলে মনে হচ্ছে।

উপরোক্ত আলোচনা অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সিনিয়র নেতা ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমার আগে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এর মাধ্যমে কার্যকরভাবে তৃণমূল এবং অন্যান্য নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাজি করানোর সম্ভাবনাকে (যতো কমই হোক না কেন) হত্যা করা হয়েছে।

অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই

সংক্ষেপে বললে, তফশিল ঘোষণার পর থেকে নেতাকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন এবং উপরে আলোচিত অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়ের কারণে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে বিএনপি নেতাদের পিছু হটবার কোনো অবকাশ ছিল না।

এটি তৃণমূলের এই বক্তব্যকেই আরও প্রমাণ করেছে যে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়৷ আগামী নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকে আ.লীগকে কার্যকরভাবে ওয়াকওভার দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না।

[সিডনি পলিসি এন্ড এনালাইসিস সেন্টারের রিসার্চ এন্ড কমিউনিকেশন অফিসার আকিব মোঃ সাতিলের এই নিবন্ধ ১৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক খ্যাতনামা ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে]
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d