বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার লুট করার পরিকল্পনা ছিল

মেঘনা আলমের গ্রেফতার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না : আইন উপদেষ্টা
‘‘তদন্ত করতে গিয়ে আগের সরকারের সময় সীমাহীন গাফিলতি দেখা গেছে। তদন্তের আগেই সিআইডিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা ইনভলব আছে তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেয়া হয়।’’
- ৭১৮৪ মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ
- মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণের মামলার চার্জশিট প্রস্তুত
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার চুরি বা লুট করার পরিকল্পনা ছিল। শেষ পর্যন্ত পেরেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে ৬৬ মিলিয়ন ডলার এখনো উদ্ধার করা যায়নি। বাকি টাকা উদ্ধার হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাছে মনে হয়েছে, এটি আসলে পুরো বাংলাদেশ লুট করার একটি পরিকল্পনা ছিল। দুই বিলিয়ন ডলার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলে যেত আজকে দুর্ভিক্ষ বা প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থায় পড়তে হতো। এটা অত্যন্ত গুরুতর এবং জঘন্য ফিন্যানসিয়াল ক্রাইম এবং বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র। গতকাল রোববার আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে রোববার রিজার্ভ চুরির ঘটনা বিশ্লেষণে গঠিত পর্যালোচনা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এটা তদন্ত করতে গিয়ে আগের সরকারের সময় সীমাহীন গাফিলতি দেখা গেছে। তদন্তের আগেই সিআইডিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা ইনভলব আছে তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেয়া হয়। ফরাসউদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, সেটা দেখেছি। সিআইডি রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে কমিটি তা জানতে চেয়েছে। কী ব্যবস্থা নিতে হবে সেটাও আমরা বলে এসেছি।
আসিফ নজরুল বলেন, পর্যালোচনা কমিটির প্রধান হিসেবে তার কাছে মনে হয়েছে, এটি আসলে পুরো বাংলাদেশ লুট করার একটি পরিকল্পনা ছিল। দুই বিলিয়ন ডলার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলে যেত আজকে দুর্ভিক্ষ বা প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থায় পড়তে হতো।
গাফিলতির প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, তদন্তের আগে সিআইডিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা জড়িত আছেন, তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেয়া হয়। আমরা এই বিষয়টি অবহিত হয়েছি।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ অংশে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সিআইডির তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, দায়ীদের নাম এখনই ডিসক্লোজ করছি না। এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কি না দেখা হচ্ছে। রিজার্ভ উদ্ধারে বিদেশে যে লিগ্যাল ফার্ম নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সেখানেও অনিয়ম থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন পর্যালোচনা কমিটির প্রধান। তখনকার সরকার কিছু লিগ্যাল ফার্মকে রিজার্ভ উদ্ধারের কাজ দিয়েছিল। ওই ফার্মের সাথে গত সরকারের ঘনিষ্ঠ একজন আইনজীবী জড়িত ছিলেন। এই ফার্মকে লাখ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। তাদের সাথে ইমেইল আদানপ্রদান করলেও টাকা দিতে হয়।
এত বেশি টাকার বিনিময়ে ফার্মটাকে বাছাইয়ের পেছনে ওই সরকারঘনিষ্ঠ আইনজীবীর কী সংশ্লিষ্টতা, সেটাও আমরা দেখতে বলেছি। কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়েছিল কি না দেখব।
তিনি বলেন, বাকি টাকা উদ্ধারের জন্য যে প্রক্রিয়া, সেখানে গতিশীলতা আনার জন্য আমরা কাজ করব। আমরা জানতে চেয়েছি বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনায় গত মাসে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ছয় সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে সরকার। পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা হলেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল হুদা।
এই কমিটির কাজের পরিধি হিসেবে রয়েছে, কমিটি ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্ত কাজের অগ্রগতি ও এ-সংক্রান্ত সরকারি অন্যান্য পদক্ষেপের পর্যালোচনা, এ ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং এর পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দেবে। তিন মাসের মধ্যে কমিটিকে তাদের সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনা করতে গত ১২ মার্চ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে সভাপতি করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করেছে সরকার। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। স্থানান্তরিত এসব টাকা পাঠানো হয়েছিল ফিলিপিন্সে তিনটি ক্যাসিনোতে। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে ফিলিপিন্স সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিলেও বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার আর পাওয়া যায়নি।
মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণের মামলার চার্জশিট প্রস্তুত : মাগুরার সেই শিশু ধর্ষণের মামলায় পুলিশ চার্জশিট প্রস্তুত করেছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, তারা আশা করছেন, চার্জশিট রোববার আদালতে দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পরিবর্তনের পর চার্জশিট দাখিল হবে। এ অনুসারে ধর্ষণ মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। তবে যেহেতু মাগুরার ঘটনায় ডিএনএতে আলামত মিলেছে, তাতে তিনি ধারণা করছেন, আরো দ্রুতগতিতে তদন্ত শেষ হবে।
৭১৮৪ মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ : সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে যে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে, তার মধ্যে এ পর্যন্ত ৭ হাজার ১৮৪টি মামলা আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশ করার পর তা প্রত্যাহারে অল্প কিছুদিন লাগে বলে জানান উপদেষ্টা।
সাম্প্রতিক সময়ে জামিনের প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, জামিন হলেও বলা হয় আইন মন্ত্রণালয় কী করছে, আসিফ নজরুল কী করছেন? তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মামলায় যেসব জামিন হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছেন, প্রায় সব মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। হাইকোর্টের বিষয়ে কোনো মন্তব্য বা ব্যাখ্যা করার এখতিয়ার তাদের (আইন মন্ত্রণালয়) নেই। এখানে অধিকাংশ মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন হয়েছে। যেমন বগুড়ার ১৩০টি মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অধস্তন আদালত যে কাজটি করেন, যখন আগাম জামিনের মেয়াদ শেষ হয়, তখন আবার জামিন চাইতে গেলে অধস্তন আদালত থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই জামিনকে বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধস্তন আদালত থেকেও জামিন দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আসার পর তা পর্যালোচনা করে দেখেছেন। তাতে দেখা গেছে, যারা জামিন পেয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা এজাহারভুক্ত আসামি নন।
মেঘনা আলমের গ্রেফতার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না : আসিফ নজরুল বলেন, তাকে ডিটেনশন দেয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শুধু একটা জিনিস বলতে চাই, আমরা উচ্চপর্যায়ে মিটিং করেছি। এই ব্যাপারে বিভিন্ন মানবাধিকারের বক্তব্য, আমরা সচেতন আছি। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, মডেল মেঘনা আলমের ব্যাপারে কিছু তদন্ত করছে পুলিশ। তিনি আরো বলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আছে। তাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট সেটা সঠিক ছিল না। তার যদি কোনো অপরাধ থাকে সেই অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এটা আমরা স্বীকার করছি যে গ্রেফতারি প্রক্রিয়াটা ঠিক ছিল না।