বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বাধা সীমান্ত বেড়া
‘সীমান্ত বেড়া’ এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশ এক সময় একে অপরের ভালো প্রতিবেশী ছিল। এখন ক্রমেই বাড়ছে দূরত্ব। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গত ৬ই জানুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে সীমান্তের ১২০০ মিটার প্রসারিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু করার পরে বিরোধ চরমে ওঠে। অবৈধ অভিবাসন এবং আন্তঃসীমান্তে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধ করার জন্য ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তে বেড়া দিয়ে আসছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে নয়াদিল্লি এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতার অধীনে বেড়া দেয়ার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু আগস্টে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের জেরে হাসিনা ঢাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন এবং ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বিএসএফের মতে, জুন মাসে বর্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত বেড়া নির্মাণের কাজ চলমান ছিল। কিন্তু নভেম্বরে বেড়ার কাজ পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আপত্তি দেখানোয় তা বন্ধ করতে হয়। সীমান্ত বেড়া নির্মাণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধিতা এই বিতর্ক থেকে উদ্ভূত যে বেড়া একটি প্রতিরক্ষা কাঠামো। এদিকে ভারত দাবি করে যে এটি একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এখন, নয়াদিল্লি পুনরায় কাজ শুরু করার পরে নতুন করে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
ভারত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বেড়ার কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছে, অন্যদিকে ঢাকা নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। ভারত বলেছে যে, কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন চুক্তির পরিধির মধ্যেই রয়েছে। দুই দেশ প্রতিবাদ ও পাল্টা প্রতিবাদ জানাতে একে অপরের কূটনীতিকদের ডেকে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে গত ১২ই জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডেকে পাঠায় এবং বেড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। একদিন পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নুরুল ইসলামকে ডেকে পাঠায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “কাঁটাতারের বেড়া, বর্ডার লাইটিং, প্রযুক্তিগত ডিভাইস স্থাপন এবং গবাদি পশুর ওপর নজর রাখা সীমান্ত সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে। আমরা আশাকরি যে এই বিষয়ে পূর্বের সকল সমঝোতা বাংলাদেশ অপরাধ মোকাবিলায় সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করবে।”
বিএসএফ’র একটি সূত্র দ্য স্ট্রেইটস টাইমসকে জানিয়েছে যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের পরে বেড়া নির্মাণ বন্ধ করা হয়েছে, কারণ নয়াদিল্লি সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াতে চায় না। বিএসএফ’র একটি সূত্র বলেছে, “আমরা (সীমান্তে) উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়াতে আমাদের সমস্ত বিকল্প ভেবে দেখবো। ঢাকাও জোর দিয়েছিল যে সীমান্তে পরিস্থিতি স্থিতিশীল, কোনো পক্ষই বিতর্ক বাড়াতে চায় না।”
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ১৫ই জানুয়ারি বলেন, “এখন সীমান্তে কোনো উত্তেজনা নেই”। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, ১৯৮০-এর দশকে শুরু হওয়া সীমান্ত বেড়া প্রকল্পটি কঠিন ভূখণ্ড, নদী এবং নিচু জমি, ভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা এবং সীমান্তের কাছাকাছি মানুষের বসবাসের কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণে অত্যধিক বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছে। উপরন্তু, প্রস্তাবিত বেড়ার কাছাকাছি বসবাসকারী এবং সহজে প্রবেশাধিকার বিচ্ছিন্ন করতে চায় না এমন লোকদের বাধার কারণে সীমান্তে বেড়া দেয়া বিলম্বিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে প্রায় ২৪ কিলোমিটার বেড়া দেয়া হয়েছিল। ৪,০৯৭ কিলোমিটার সীমান্ত বরাবর প্রায় ৯০০ কিমি এলাকা এখনো বেড়হীন অবস্থায় রয়েছে। ভারতের দীর্ঘমেয়াদি মিত্র হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের প্রতি গভীরভাবে অবিশ্বাসী রয়ে গেছে। বিশেষ করে, ডজন ডজন ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে নয়াদিল্লির অস্বীকৃতি উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই মামলাগুলো ২০২৪ সালের জুলাই এবং আগস্টের মধ্যে সহিংস বিক্ষোভের ওপর পুলিশি দমন-পীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। যারপর হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তার শাসনামলে বিরোধীদের হত্যা ও অপহরণের একাধিক অভিযোগও উঠেছে। ব্যাপক জনপ্রিয় ছাত্র বিক্ষোভের সময় নয়াদিল্লি নীরব ভূমিকা পালন করেছে, যা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ছয় মাসে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা দু’দেশের সম্পর্কের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করেছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তার জেরে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, হাসিনার শাসনামলে যা খুব একটা দেখা যায়নি। ইউনূস সরকার বলেছে যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার রিপোর্ট অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত বছরের নভেম্বর মাসে হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে ভারতে হিন্দু গোষ্ঠীগুলোও বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের ওপর এটিকে নতুন আক্রমণ হিসেবে দেখেছেন।
বিশেষ করে, হিন্দু সংগ্রাম সমিতি সংগঠনের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন চত্বরে সম্পত্তির ক্ষতি করে এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে। যার জেরে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ।পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, বেড়া নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক দু’দেশের সম্পর্কের অবনতির দিকেই ইঙ্গিত করে। নয়াদিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক হর্ষ ভি. পান্ত বলেছেন- “আমি মনে করি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যা রয়েছে, দেশটি ভারতকে এখন প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে। তাদের কাছে পাকিস্তান এখন বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।”
তারপরও দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মূল্য ছিল ১৪.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দুই প্রতিবেশীর অর্থনৈতিক সংযোগের মধ্যে রেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের একজন রিসার্চ ফেলো ড. অমিত রঞ্জন বলেছেন যে, অনেক অর্থনৈতিক সংযোগের কারণে দুই দেশকে সম্পর্ক ঠিক করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ড. অমিত রঞ্জন মনে করেন, ‘বাংলাদেশ নিজেদের ভূগোল ও অর্থনীতির কারণে বলতে পারে না যে তারা ভারতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। এবং ভারতও বলতে পারে না যে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু এখন এই সম্পর্কগুলো টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি যোগ করেছেন যে ভারতের জন্য সর্বোত্তম নীতি হবে- এই সময়ে চুপ করে থাকা এবং চলমান রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে বাংলাদেশে কী ঘটনা ঘটে তা দেখা। ‘নয়াদিল্লিকে এইসময় ধৈর্য ধরতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে, ভারত- বাংলাদেশ উভয়কেই একসঙ্গে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’ বলে মনে করেন ড. অমিত রঞ্জন।