বাজার পরিস্থিতি: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কঠিন
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২৫ টাকার মধ্যে। এক বছর পর বাজারে এখন একই আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। দরটি দ্বিগুণের বেশি।
দেশে আলুর মতো বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম এখন চড়া। মূল্যস্ফীতিও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থবারের মেয়াদ শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বছরের প্রথমে বাজারে বাড়তে শুরু করেছে চালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। তার কারণ তিনটি। প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। সরকারের পক্ষে সেটি কঠিন। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ, সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে।
২০২২ সালের মে মাসের দিকে দেশে মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন আমদানিতে নির্ধারিত দর ১১০ টাকা। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে তাঁদের ১২৪ টাকাও লাগছে। ফলে এ সময়ে শুধু ডলারের দামের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। গম, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও জিরার মতো নিত্যপণ্য এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে ডলারের দর।
বছরের শুরুতে কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে। টিসিবির হিসাবে ঢাকা বাজারে ৮ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটা চাল, প্যাকেটজাত আটা, ময়দা, মসুর ও মুগ ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ৪ ধরনের মসলা ও ব্রয়লার মুরগি—এই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ৫০ টাকা। কমেছে আলু ও জিরার দাম।
নতুন সরকার বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দাম কমানো কখনোই সম্ভব হবে না। তবে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাঁর মতে, সরবরাহ যেহেতু কম, সেহেতু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির চেয়েও দেশে দর বেশি বেড়েছে। এতে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন বড় ব্যবসায়ীরা। গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে।
আহসান মনসুর আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এখন একটিই কৌশল হতে পারে, সেটি হলো ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়িয়ে ১৬–১৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। সঙ্গে সরকারের বাজেট ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার মতো কমিয়ে ফেলতে হবে। এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়।
তখন স্বস্তি, এখন অস্বস্তি
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। ওই সময় মূল্যস্ফীতি কম ছিল, এখনকার মতো ডলারসংকট ছিল না। বিশ্ববাজারও স্থিতিশীল ছিল, জ্বালানির দামও ছিল কম। এবার চিত্রটি ভিন্ন। মূল্যস্ফীতি বেশি, ডলার–সংকট চলছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে সুফল তেমন একটা নেই।
নিত্যপণ্যের দাম মূলত বাড়তে থাকে ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনাকালের শুরুতে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরই বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বিপরীতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকে। বাড়তে থাকে ডলারের দাম। এর প্রভাব পড়ে প্রায় সব পণ্যের দামে। এ সময় সরকারও সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার বাজারে চিনির কেজিপ্রতি দর ছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। এখন যা ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। শুধু চিনি নয়; চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, মসলাজাতীয় পণ্য, দুধ, ডিম, মাংস, সাবান, টুথপেস্ট—প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছিতে।
দাম কমানো কখনোই সম্ভব হবে না। তবে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক,পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই)
নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় যাতে কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকে, সেটি নিশ্চিত করাই হবে তাঁর প্রধান কাজ। উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে দামের পার্থক্য যৌক্তিক রাখা, মজুতদারি রোধ, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পবিত্র রমজান মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা।
বাড়ছে দাম
বছরের শুরুতে কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে। টিসিবির হিসাবে ঢাকা বাজারে ৮ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোটা চাল, প্যাকেটজাত আটা, ময়দা, মসুর ও মুগ ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ৪ ধরনের মসলা ও ব্রয়লার মুরগি—এই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ৫০ টাকা। কমেছে আলু ও জিরার দাম।
বগুড়া ও কুষ্টিয়ার পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানকার আড়তে চালের দাম বাড়তি। চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনে চালের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে।
রাজধানীর বাজারেও চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের শাহ আলী মার্কেটের মুদিদোকান জাকির অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিক্রেতা মেহেদি হাসান বলেন, চালের দাম বেড়েছে। তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। প্যাকেটজাত মসলার দামও বাড়তি। তিনি বলেন, চালের মধ্যে মাঝারি বিআর–২৮ জাতের দাম কেজিতে তিন টাকার মতো বেড়েছে। অন্য চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে তাঁরা এখনো ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নেওয়া শুরু করেননি।
বেড়েছে গরুর মাংসের দামও। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই দামে বিক্রি শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে কোনো কোনো বাজারে গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর শীত শুরু হলে মৌসুমি সবজি, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার দর গত বছরের মতো কমেনি। সে ক্ষেত্রে আলুর পাশাপাশি পেঁয়াজের উদাহরণও সামনে আসছে। গত বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪৫ টাকা। এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
বেড়েছে গরুর মাংসের দামও। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই দামে বিক্রি শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে কোনো কোনো বাজারে গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে।
সবজির দাম যে কমছে না, তার উদাহরণ ফুলকপি। খুচরা বাজারে এখন মাঝারি আকারের একটি ফুলকপির দাম ৬০ টাকার আশপাশে, যা গত বছর একই সময়ে ৪০ টাকার নিচে ছিল বলে দাবি করেন বিক্রেতারা। কারওয়ান বাজারের সবজির আড়ত ভাই ভাই বাণিজ্যালয়ের মালিক জাকির হোসেন বলেন, ‘সবজির দাম গত বছরের শীতের চেয়ে অনেক বেশি। সব খরচই বেড়ে গেছে। এ কারণে কম দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না।’
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৮–১৯ থেকে শুরু করে পরের তিন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। পরের বছরগুলো মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হারে বেড়েছে।
সর্বশষে গত নভেম্বরের হিসাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও পানি
সরকার বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও পানির দাম সমন্বয়ের ইঙ্গিত নির্বাচনের আগেই দিয়ে রেখেছে। যেমন গত ৯ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে তখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, সরকার ভর্তুকির ধারণা থেকে সরে আসতে চায়। শুরুতে বিদ্যুৎ ও পানিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হবে। গ্রাহকের এলাকা, আয় ও পারিবারিক অবস্থান—এই তিন দিক বিবেচনা করে বিদ্যুৎ ও পানির দাম ঠিক করা হবে।
ওদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মানতে জ্বালানি তেলের দাম গত সেপ্টেম্বরে বাজারভিত্তিক করার কথা ছিল। সে জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম নির্ধারণের সূত্রও ঠিক করে রেখেছে মন্ত্রণালয়। তবে ভোটের আগে তা কার্যকর হয়নি। এখন হতে পারে।
বাজারে কাটছাঁট করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন আর কোনো উপায় নেই।
আশফাক ইসলাম, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী
সব মিলিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ে স্বস্তির আশা করা যাচ্ছে না। মিরপুরের শাহ আলী মার্কেট কাঁচাবাজারে গতকাল বিকেলে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন স্থানীয় টোলারবাগের বাসিন্দা আশফাক ইসলাম। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ব্যবসা পরিস্থিতি ভালো না থাকায়, তাঁর প্রতিষ্ঠান বেতন বাড়ায়নি; কিন্তু বাজারে সবকিছুর দামই বেড়েছে।
আশফাক বলেন, বাজারে কাটছাঁট করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন আর কোনো উপায় নেই। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দেখেন না তিনি।