Trending

বাজেট ঘাটতি কমানো হচ্ছে

অর্থনীতিতে চলমান সংকট বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের ব্যয় পরিকল্পনায় উচ্চাভিলাষ দেখাচ্ছে না সরকার। ব্যয়ের আকার বাড়ছে ৫ শতাংশেরও কম। বাজেট ঘাটতিও কমছে। জিডিপির অনুপাতে ঘাটতি এক দশক আগের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি চলতি অর্থবছরের প্রাক্কলনের তুলনায় প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা কমছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) ৪ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ ঘাটতি প্রাক্কলন করা হচ্ছে, যা ১০ বছর আগে ছিল। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ৫ শতাংশের খুব কাছাকাছি বাজেট ঘাটতির পরিকল্পনা ছিল। কোনো কোনো বছর ৫ শতাংশের বেশিও ছিল। বাজেট ঘাটতি বলতে রাজস্ব আয়ের বাইরে ঋণের মাধ্যমে ব্যয়ের পরিমাণকে বোঝানো হয়ে থাকে।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। এর পরের অর্থবছরগুলোতে সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২ শতাংশ ঘাটতি ধরে বাজেট দেওয়া হয়। আসন্ন বাজেট বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। তবে অর্থনীতি দীর্ঘায়িত সংকটের সম্মুখীন হওয়ায় আগামী অর্থবছরে বাজেটের ঘাটতি কমিয়ে আনা হচ্ছে।

ঘাটতি মেটাতে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা (অনুদান ছাড়া) দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা থাকছে; যা আগামী অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বাজেটে জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই এমন ঘোষণা আসছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনোভাইরাস বিধিনিষেধে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধও ২০২২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নীতি দুর্বলতা, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ চাপে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ব্যয়ের প্রাক্কলন ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

নতুন বাজেটের ব্যয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। এর আগের অর্থবছরগুলোতে সাধারণত পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে বাজেট দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে সরকার। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ ছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর ১৫ হাজার কোটি এবং কর ছাড়া রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ৪৬ হাজার কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। আর বৈদেশিক অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার নিট অর্থায়ন পাওয়া যাবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। স্থানীয় প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাংক খাত। এ খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের প্রাক্কলন করা হচ্ছে। এর বাইরে সরকারি চাকুরেদের ‘জিপিএফ’সহ অন্যান্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, আগামী বাজেটকে খুব বেশি সংকোচনমূলক বলা যাবে না, বরং বলা যায় ‘মডারেটলি এক্সপানশনারি’ বাজেট। কারণ বাজেটে ঘাটতি থাকলে এবং ব্যয়ের পরিমাণ একটু বাড়লেই তা সম্প্রসারণমূলক। তবে এরই মধ্যে ঘোষিত মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আশা করা যায় নতুন বাজেট মুদ্রানীতির লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজস্ব আরও বাড়িয়ে ঘাটতি যদি জিডিপির ৪ শতাংশের ঘরে রাখা যেত, তাহলে আরও ভালো হতো। তা ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের অর্থায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বাজেট ঘাটতি কমানো হচ্ছে, আরও কমাতে পারলে ভালো হতো। কারণ, এরই মধ্যে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ বেড়ে গেছে। আগামী দিনে আরও বাড়বে। তাই সামনে ঋণ কমিয়ে নিজস্ব অর্থ ব্যয় বাড়াতে হবে। দীর্ঘদিন রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যেভাবে কথা বলা হচ্ছে, একইভাবে রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তা প্রয়োজন। কারণ ৮ শতাংশের কম কর-জিডিপির অনুপাত দিয়ে টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।

এদিকে বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। কোনোভাবেই এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই। যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর আগেই পার করেছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। দেশে ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সংশোধিত বাজেটে তা সাড়ে ৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়। আগামী বাজেটেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশই ধরা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button