বাড়ছে রোগী–মৃত্যু, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
শুধু বৈঠক করা ও নির্দেশনা দেওয়ার মধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজ কার্যত সীমিত রেখেছে।
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2023/09/prothomalo-bangla_2023-09_53bbd2bd-ef69-4127-a7ab-87c02f46db2f_16092023_cm_1.webp)
দেশের কোথাও কোনো নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা পাওয়া গেলে প্রথমে ভবনমালিককে সতর্ক করা হবে। দ্বিতীয়বার পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে বন্ধ করে দেওয়া হবে নির্মাণকাজ।
সচিবালয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে এক আন্তমন্ত্রণালয় এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দেশের কোনো জেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি তদারকি করেনি। নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়ার মতো শক্ত অবস্থান দেখা যায়নি।
তদারকি যেমন হচ্ছে না, তেমনি অর্থ বরাদ্দও সামান্য। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা ও প্রচার খাতে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যয়ের বাইরে) ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। পৌরসভাগুলোকে সেখান থেকে শ্রেণিভেদে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ টাকার বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে গত ১৬ আগস্ট। এর আগে সিটি করপোরেশনগুলোকে দেওয়া হয়েছে মোট ১০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এই বরাদ্দ একেবারেই কম।
‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন যেসব কাজ করে, প্রতিদিন সেসব তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। মাঝেমধ্যে আমাদের কর্মকর্তারা সিটি করপোরেশনে পরিদর্শনে যান। তবে জনবলের অভাবে সবখানে যাওয়া সম্ভব নয়।’
মলয় চৌধুরী, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা মারার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। মশা মারার কার্যক্রম তদারকির কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগের। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের কাজ বৈঠক করা ও নির্দেশনা দেওয়ার মধ্যে সীমিত। কিন্তু বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, তা তদারকি করা হচ্ছে না।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আসলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এতে মশাও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ফলে দেশের সব কটি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়মিত মানুষ মারা যাচ্ছেন। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৯০ জন। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছেন ১৩ জনের বেশি মানুষ। বাবা-মায়েরা শিশুসন্তানকে হারাচ্ছেন, সন্তানেরা মা-বাবাকে হারাচ্ছে—স্বজন হারিয়েছে বহু মানুষ।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মলয় চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন যেসব কাজ করে, প্রতিদিন সেসব তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। মাঝেমধ্যে আমাদের কর্মকর্তারা সিটি করপোরেশনে পরিদর্শনে যান। তবে জনবলের অভাবে সবখানে যাওয়া সম্ভব নয়।’
ঢাকার বাইরে মশক নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে উঠেছে এই কারণে যে মৌসুমের শুরুর দিকে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি ছিল। এখন ঢাকার বাইরে অনেক রোগী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কার্যক্রম একেবারেই কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের মূল কাজ রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১৬টি কাজ
ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ২০২১ সালে জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে বলা হয়েছে, সাধারণত বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বছরের যেকোনো সময় কম-বেশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ কারণে তাদের প্রতিপাদ্য হলো, ‘জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর, মশক নিধন বছর ভর’।
নির্দেশিকায় বিস্তৃতভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্য ১৬টি কাজ নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনের মধ্যে সমন্বয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ, কীটনাশক সংগ্রহ ও ব্যবহারে প্রশিক্ষণ তদারকি, মশা নিয়ন্ত্রণে সফল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়া ইত্যাদি।
নিজেদের করণীয় কতটা পালন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, তা খোঁজ নিতে গত রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ছয়বার গিয়েছিলাম সেখানে। প্রতিবারই একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। জানা যায়, বেশির ভাগ কর্মকর্তা ব্যস্ত দৈনন্দিন কাজ ও স্থানীয় সরকার দিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠান আয়োজনে। গত বৃহস্পতিবার দিবসটি উপলক্ষে আট হাজার জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠান হয়েছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে গত মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ বা কন্ট্রোল রুম প্রতিষ্ঠা করেছে। এর কাজ সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম তদারকি করা। নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব শামীম ব্যাপারী।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ মাসের মধ্যে সব কমিটি গঠন সম্ভব হবে।
শহিদুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক
স্থানীয় সরকার বিভাগে কয়েক দফা গিয়ে শামীম ব্যাপারীকে পাওয়া যায়নি। তাঁকে ফোন করা হয়েছিল, তবে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ব্যস্ত মূলত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা ও স্থানীয় সরকার দিবস উদ্যাপন নিয়ে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন তাদের দৈনিক কার্যক্রম স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দেয়। একটি সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রমের নথিতে দেখা যায়, কোথায় কোথায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে তার তালিকা। তবে নাম প্রকাশ করার শর্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিদিন গৎবাঁধা দৈনিক কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। মাঠে আসলে এসব কাজ হয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রম নজরদারি করার মতো সামর্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই।
সরেজমিন তথ্য বলছে, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা গাফিলতি করছেন। বিকেলে উড়ন্ত মশা মারতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশককর্মীদের প্রতিদিন যে পরিমাণ ওষুধ দিচ্ছে, তা দিয়ে দুই ঘণ্টা ধরে ফগিং (ধোঁয়া) করার কথা। কিন্তু এই কাজ আধা ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করে ঘরে ফিরছেন কর্মীরা।
পৌরসভার নিজস্ব টাকা দিয়ে মশা নিধন করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বছরে সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। যেটা দিয়ে আসলে কিছু হয় না।
খালিদ হোসেন, মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) সাধারণ সম্পাদক ও মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র
কমিটির খবর কী
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জারি করা নির্দেশিকায় জাতীয় পর্যায়ে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কমিটি প্রতি মাসে একটি করে সভা করবে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে তারা সব ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ জানিয়েছে, জাতীয় কমিটি এ বছর এখন পর্যন্ত পাঁচটি সভা করেছে। সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তার সুফল যে নেই, তা ডেঙ্গুর পরিসংখ্যানে স্পষ্ট।
আটটি জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, জেলা পর্যায়ে থাকলেও পৌরসভা ও ইউনিয়নে এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়নি। জেলা পর্যায়ের কমিটির তেমন কোনো কাজ নেই।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে বরিশালে। সেখানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জেলা পর্যায়ে কমিটি হলেও এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ মাসের মধ্যে সব কমিটি গঠন সম্ভব হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ রাস্তাঘাট, সেতু, ভবন নির্মাণ করা। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ তাদের কাজ নয়। এ কাজে তাদের অভিজ্ঞতাও নেই। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতাত্ত্বিক দল থাকা জরুরি।
বে-নজির আহমেদ, সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ
উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ শুধু মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেমন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের সভায় সব ইউনিয়নে সচেতনতার জন্য প্রচার চালানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা এলাকায় মাইকিং করেছি। এর বাইরে কিছু না।’ পটুয়াখালীতেও ইউনিয়ন পর্যায়ে এখনো ডেঙ্গু প্রতিরোধে কমিটি হয়নি।
লক্ষ্মীপুরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কমিটি হয়নি। জেলায় চারটি পৌরসভা রয়েছে। শুধু লক্ষ্মীপুর পৌরসভায় আট সদস্যের ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর সভাপতি পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া। কমিটির কোনো সভা হয় না। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার ওষুধ ছিটানো ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয় বলে দাবি করেন মেয়র।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেওয়া কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাওয়া যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হককে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়, তা কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটি দেখার কেউ নেই। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কতটুকু পানিতে কতটুকু মশা মারার ওষুধ দিতে হবে, অনেকে এটা জানে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, তারা দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে বিগত চার অর্থবছরে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নিজস্ব খাতে বরাদ্দ রাখা থাকে।
চার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কতটুকু
ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে গত ৫ জানুয়ারি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় দেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, কীটতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের কাছে ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে সুপারিশ চাওয়া, ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত কমিটির নিয়মিত সভা আয়োজন করে আলোচনা স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো, এডিসসহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) কার্যক্রম চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো পরামর্শ নিয়েছে কি না জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে বিখ্যাত ছয়জন কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, তাঁদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, যাঁদের পরামর্শ নেওয়া হয়, তাঁদের মশা মারা কিংবা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কমিটিতে তিনি রয়েছেন। মাঝেমধ্যে কমিটির সভা হয়, তাঁর বক্তব্য শোনা হয়। কাজ হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পদার্থবিদ্যায় বল প্রয়োগের ফলে যদি সরণ হয়, তাহলে তাকে কাজ বলে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেক কাজের কথা বলা হচ্ছে, ফল তো দেখি না।’
এদিকে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তের কাজটি বেশি দূর এগোয়নি। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) কার্যক্রম চূড়ান্ত করা যায়নি। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বরাদ্দ কম
স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, তারা দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে বিগত চার অর্থবছরে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নিজস্ব খাতে বরাদ্দ রাখা থাকে।
মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) সাধারণ সম্পাদক ও মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন বলেন, পৌরসভার নিজস্ব টাকা দিয়ে মশা নিধন করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বছরে সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। যেটা দিয়ে আসলে কিছু হয় না।
তারা পারেনি, পারবে না
বাংলাদেশে যখন ডেঙ্গু বাড়ছেই, তখন প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের শহর কলকাতা মশা নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সফল। তারা ফগার মেশিন দিয়ে মশা না তাড়িয়ে উৎপত্তিস্থলেই মশাকে ধ্বংস ও বংশবিস্তার রোধ—শুরু থেকেই এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।
কলকাতায় কোনো রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তিনি কোথায় আক্রান্ত হয়েছেন, তার উৎস খোঁজা হয়। আক্রান্তের বাড়ি ও আশপাশের ৫০টি বাড়ি তদারকি করে কোথাও শূককীট পাওয়া গেলে সেখানে কার্যকর ওষুধ দেওয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত কলকাতায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। কলকাতা থেকে শুভজিৎ বাগচী জানান, সরকারিভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক কোনো হিসাব প্রকাশ না করা হলেও অনানুষ্ঠানিক হিসাবে এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সাতজন মারা গেছেন।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ রাস্তাঘাট, সেতু, ভবন নির্মাণ করা। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ তাদের কাজ নয়। এ কাজে তাদের অভিজ্ঞতাও নেই। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতাত্ত্বিক দল থাকা জরুরি। কিন্তু এ জায়গায় মারাত্মক ঘাটতি আছে।
বে-নজির আহমেদ বলেন, বিগত ২০ বছরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যেটা পারেনি, আগামী ২০ বছরেও তাদের পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যার কাজ তাকে দিয়েই করানো উচিত। তিনি মশা মারার কাজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়ার পরামর্শ দেন।