Bangladesh

বিআরটিএতে ঘুষের তিন রেট

  • ৫ বছরে ১১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আদায়
  • অটোরিকশা ভাঙতে ৫০ হাজার, নম্বর প্লেট নিতে ২৫ হাজার
  • ভাঙা অটোরিকশা ফেরত পেতে ১০ হাজার টাকা
  • সমিতির নেতা ও দালালরাও ভাগ পান

আয়ুষ্কাল শেষে নিজের সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপন করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে গিয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন মো. আব্দুল্লাহ কাফি মাসুম। তার একটিই মাত্র অটোরিকশা। সেটা প্রতিস্থাপনের জন্য প্রথমে ভাঙার জন্য সরকারি ফি ছাড়াও তার কাছে টাকা দাবি করা হয়। পরে তিনি অটোরিকশা ব্যবসায়ী ও মালিকদের সংগঠনের মাধ্যমে করিয়েছেন। 

মাসুম বলছিলেন, প্রথমে ভাঙার জন্য তাকে ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এরপর নতুন নিবন্ধন নিতে দিতে হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু ভাঙার পর অটোরিকশার ভগ্নাবশেষ তাকে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি।

তার এমন অভিজ্ঞতা শুনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অটোরিকশা বদলে অটোরিকশা নিতে গেলে বিআরটিএতে তিন ধাপে ঘুষ দিতে হয়। এর জন্য আলাদা রেট আছে। প্রথম ধাপে ভাঙতে দিতে হয় কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা, এরপর নতুন নিবন্ধন নিতে ২৫ হাজার ও ভাঙা অটোরিকশা ফেরত পেতে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট সার্কেলের অসাধু কর্মকর্তা ও অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতাদের যোগসাজশে ঘুষ নিয়ে এই কাজ করা হয়।

জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছরে ১২ হাজার ৫০০ অটোরিকশা প্রতিস্থাপন ও মেয়াদ বাড়াতে ১১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে শুধু প্রতিস্থাপন করতেই ঘুষ নেওয়া হয়েছে প্রায় ১০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকনের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া লিখিত অভিযোগ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

ওই অভিযোগ থেকে জানা গেছে, বিআরটিএ’র ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী-মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু ও সদস্য সচিব এটিএম নাজমুল হাসান যোগসাজশ করে এই ঘুষ বাণিজ্য চালান।

জানতে চাইলে খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে অভিযোগের কথা বলছেন, এর সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত না। তাই এই বিষয়ে আমি কি বলবো সেটিও বুঝতে পারছি না।’

ওই অভিযোগ থেকে জানা গেছে, রাজধানীতে ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এসব গাড়ির ইকোনমি লাইফ (আয়ুষ্কাল) ধরা হয় ১৫ বছর। এরপর অটোরিকশাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এসব গাড়ি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ধাপে ধাপে প্রতিস্থাপন শুরু করে বিআরটিএ। এর জন্য তখন একটি কমিটি করা হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন বিআরটিএ’র তখনকার উপপরিচালক। এর জন্য তখন সরকারি ফি ছিল ১২ হাজার ১০০ টাকা।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সব অটোরিকশা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এসব অটোরিকশার মালিকদের নতুন করে আবার নিবন্ধন নম্বর দেওয়া হয়েছে। 

প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়ার প্রথমে অটোরিকশাটি ভেঙে ফেলা হয়। এরপর নিবন্ধন দেওয়া হয়। ভেঙে ফেলা গাড়িটি মালিককে ফেরত দেওয়া হয়। 

দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়,  ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী-মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু ও সদস্য সচিব এটিএম নাজমুল হাসানসহ একটি চক্র প্রতিস্থাপন কাজে জড়িত। তাদের ঘনিষ্ট সহযোগীদের দালাল হিসেবে নিয়োজিত। এই দালালচক্র গাড়ি ভাঙা ও নিবন্ধনের জন্য ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে পরিষদের ওই নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। তারাই বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অংশ লেনদেন করতেন। ঘুষের এই টাকা বিআরটিএ কর্মকর্তা, মালিক সমিতির নেতা ও দালালদের মধ্যে ভাগ হয়েছে।

দুদকে দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, বিআরটিএ’র খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৬ বছর ধরে ঢাকা মেট্রো-১ সার্কেলে হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি সময়ে তিনি পদোন্নতি পেয়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (এও) হয়েছেন। তিনি নতুন পুরাতন লাইসেন্স, মালিকানা বদলি ও রোড পারমিট পাইয়ে দেওয়ার কাজও করেন।

অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, এই ১২ হাজার ৫০০ সিএনজি অটোরিকশা ভাঙতেই গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা; নিবন্ধন নিতে ২৫ হাজার টাকা করে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং গাড়ির ভাঙা অংশ ফেরতে নিতে ১০ হাজার টাকা করে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি। অর্থাৎ এসব অটোরিকশা প্রতিস্থাপনে মোট ১০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। আর অটোরিকশার মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানোর জন্য ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে মালিকদের কাছ থেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মগবাজার টঙ্গী ডাইভারশন রোডের দ্বীন ইসলাম মটরস’র মালিক হাজী আব্দুর রশিদ বুলু এক হাজার গাড়ি প্রতিস্থাপনের কাজ করেছেন। মগবাজার রেলগেট সংলগ্ন দিগন্ত অটো সেন্টারের মালিক পাঁচ শাতাধিক, উত্তরা মটরস’র ডিলার মো. সুলতান উদ্দিন এক হাজার অটোরিকশা প্রতিস্থাপনের কাজ করেছেন। তারা ছাড়া অভিযোগে আরো কয়েকজন ডিলার ও দালালের নাম রয়েছে।

ভুক্তভোগী অটোরিকশা মালিক আব্দুল্লাহ কাফি মাসুম বলেন, ‘আমার অটোরিকশাটি বিআরটিএতে ভাঙার জন্য দিলে তারা সরকারি ফি’ ছাড়াও আরও টাকা চায়। না দিলে আমার অটোরিকশা ভাঙা হবে না বলে জানায়। মালিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ বুলুকে ধরে কাজটি করিয়েছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর আবুল হোটেল এলাকার এক অটোরিকশা মালিক বলেন, ‘আমার এখনও ১০টির উপরে অটোরিকশা আছে ভাঙার জন্য। আপনাকে (এই প্রতিবেদককে) এগুলো দিচ্ছি। তাহলে বুঝবেন কতো টাকা লাগে অটোরিকশার বদলে অটোরিকশা পেতে।’ 

তিনি বলেন, ‘এমন কৌশলে এমন দুর্নীতি করা হয় সাধারণ মালিকদের কিছু বলার থাকে না। আমরা কিছু বলতে গেলে রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) আটকে দেয়।’ 

এই অটোরিকশা মালিক বলেন, একটি অটোরিকশা ভাঙতে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্তও নিয়ে থাকে। 

জানতে চাইলে মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, সেই সময় ভাঙার দায়িত্বে যারা ছিলেন সেই কমিটির কাছে কেন অভিযোগ জানানো হলো না। 

তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার নিজেরও অটোরিকশা ভাঙা হয়েছে। কোনো রকম অনিয়ম হয়নি।’ এই ঘটনায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এই নেতা।

সংগঠনটির সদস্য সচিব এটিএম নাজমুল বলেন, ‘সাধারণ মালিকদের কল্যাণে বিআরটিএ’র সঙ্গে আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। কারণ সাধারণ মালিকদের সুবিধার জন্য এই সংগঠন করা। আমরা কখনো চাঁদাবাজি করি না। আর বিআরটিএ যে কর্মকর্তার কথা বলছেন তাকে আমি চিনি না।’ 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button