Bangladesh

বিএনপিপন্থী শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থিসিস করায় স্বর্ণপদকজয়ী ‘বঞ্চিত’

জাবিতে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং লোক প্রশাসন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। বিভাগীয় সভাপতিদের বিরুদ্ধে পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে স্বর্ণপদকজয়ী শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করার অভিযোগ তুলেছেন স্বর্ণপদকজয়ী শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বলি হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তবে ভিসি বলছেন, শিক্ষক নিয়োগে বিভাগের ফলাফলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য বিভাগের শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে শিক্ষার্থীদের ভুগতে হচ্ছে। যখন যে শিক্ষক বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে থাকেন, তখন তিনি তার পছন্দের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘আইওয়াশ’ ছাড়া আর কিছুই না। কাদের নিয়োগ দেয়া হবে, তা আগেই ঠিক করা থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং লোক প্রশাসন বিভাগে মোট ছয়জনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ৩৯তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ইরতিফা আলম নাবিলা, ৪৩তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল হুসনা তুয়া ও ৪৪তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী অশরাফুল হাবিবকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে, ইরতিফা আলম নাবিলা ও আশরাফুল হাবিব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুর রশিদের প্রার্থী। আর জান্নাতুল হুসনা তুয়া বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদের প্রার্থী। তবে খন্দকার হাসান মাহমুদ বিভাগের সভাপতি শাহেদুর রশিদের অনুসারী বলে পরিচিত। জানা যায়, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বর্ণপদকজয়ী দুই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা হলেন- বিভাগের ৪২তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী কামরুন নাহার ও ৩৬তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী তমা রানী সাহা। তাদের মধ্যে কামরুন নাহার বিভাগের বিএনপিপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তরের থিসিস করেছেন। ফলে প্রথমে কামরুন নাহারকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়নি। পরে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দফতরে জানাজানি হলে বিতর্ক তৈরি হয়। তখন কামরুন নাহারকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকতে বিভাগের সভাপতিকে নির্দেশ দেন ভিসি।

এ বিষয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের স্বর্ণপদকজয়ী শিক্ষার্থী কামরুন নাহার বলেন, আমাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ না দেয়ার জন্য বিভাগের সভাপতি নানা অপকৌশল অবলম্বন করেন। তিনি প্রথমে আমাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেননি। পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আমাকে সাক্ষাৎকারে ডাকেন। যোগ্যতা থাকার পরেও শিক্ষকদের রাজনীতির কারণে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, স্বর্ণপদকজয়ীদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছেন বিভাগের সভাপতি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আমার তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তরের থিসিস করায় একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া সাক্ষাৎকারের আগেই তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য না ডাকাসহ নানান অপকৌশল অবলম্বন করা হয়। যদি আমার তত্ত্বাবধানে থিসিস করা কোনো শিক্ষার্থীর অপরাধ হয়, তাহলে আমি আর কোনো শিক্ষার্থীকে থিসিস করাব না।

তবে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো: শাহেদুর রশিদ বলেন, এটা নিয়োগ বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরা যাদের যোগ্য মনে করেছেন, তাদেরকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন। তবে একজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য না ডাকার বিষয়টি জিজ্ঞেস করার আগে ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন অধ্যাপক শাহেদুর রশিদ।
এ দিকে লোক প্রশাসন বিভাগে ৪২তম ব্যাচের ছন্দা খাতুন, ৪৩তম ব্যাচের ফাইরুজ আনিকা ও ৪৪তম ব্যাচের রিফা তাসফিয়াকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ছন্দা খাতুন ও রিফা তাসফিয়া বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নুরুল আমিনের প্রার্থী। এ ছাড়া ফাইরুজ আনিকা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমানের প্রার্থী ও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের স্ত্রী। আবার মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান বিভাগের সভাপতি নুরুল আমিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকজয়ী লোক প্রশাসন বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী জাকিয়া হোসেন দ্যুতিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া ‘তুলনামূলক’ যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে কম যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য দিকে ছন্দা খাতুনের বিরুদ্ধে সহপাঠীদের মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরির অভিযোগ রয়েছে। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর হল কর্তৃপক্ষ ছন্দার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়। এ ছাড়া ফাইরুজ আনিকার ফলাফলে বিভাগের শিক্ষক (বর্তমানে স্বামী) মাহফুজুর রহমানের হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠেছে। কারণ ফাইরুজ আনিকা শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় মাহফুজুর রহমানের সাথে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। এমনকি নিয়োগে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের থেকেও কম ফলাফলধারী শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) চিঠি দিয়েছেন বিভাগের ৪২তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী জান্নাত আরা।

লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাত আরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের আগে অবশ্যই তার মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করা উচিত। তবে সেটি না করে সহপাঠীদের মোবাইল চুরিতে অভিযুক্ত ছন্দা খাতুনের মতো প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যা শিক্ষক সমাজের জন্য অপমানজনক। এ ছাড়া আমিসহ অনেক যোগ্য প্রার্থী এই নিয়োগে বঞ্চিত হয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লোক প্রশাসন বিভাগের একাধিক শিক্ষক বলেন, ‘মোবাইল চুরিতে অভিযুক্ত একজন বিভাগের শিক্ষিকা হয়েছে, এটা কখনো কাম্য ছিল না। এ ছাড়া বিভাগের সভাপতি ও তার অনুসারীরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছেন। যেখানে তুলনামূলক অধিক যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে কম যোগ্য প্রার্থীদের নেয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে লোক প্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো: নুরুল আমিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে এর আগে তিনি বলেন, বিভাগের ফলাফলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। স্বর্ণপদকজয়ী সবাইকে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তবে তাদের মধ্যে একবারেই কাউকে নেয়া হচ্ছে না তেমন না।

এ ছাড়া সশরীরে সাক্ষাতে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের একজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য না ডাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তবে আমি জানতে পেরেই ওই প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকার নির্দেশ দিয়েছি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button