Bangladesh

বিএনপি-জামায়াত বিরোধ বাড়ছে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও জামায়াতের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হতে থাকে। গত রবিবার বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী জামায়াতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনার পর তাদের মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। 

মূলত গণ-অভ্যুত্থানের পর ইসলামী ব্যাংক ‘দখল’কে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এরপর বিএনপির বিরুদ্ধে সারা দেশে ‘দখলদারিত্বের’ নানা অভিযোগ আনেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

গত রবিবার বিএনপিও জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে।

বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের ঘটনা আগেও দেখা গেছে। তবে এবারের মতো একে অন্যের প্রতি চরম বিষোদগার নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এর পরও দীর্ঘদিনের দুই মিত্র দলের সম্পর্ক ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দুই দলের নীতিনির্ধারকরা।

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির মাঠে সরব হওয়ার পর দল দুটির মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ শুরু হয়।

শেখ হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে হঠাৎ কেন এমন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলো, তা নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে।

অনেকে মনে করেন, দুই দলের মধ্যে এমন মতবিরোধ বিভিন্ন সময় দেখা গেছে।

তবে তাদের মধ্যে সম্পর্কের ইতি হয়নি। ফলে ভবিষ্যতেও দুই দলের মধ্যে যে সম্পর্ক উষ্ণ হবে না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ব্যাংকসহ পাড়া-মহল্লায় জেলায় জেলায় অনেক টার্মিনাল, সিএনজি স্ট্যান্ড দখলসহ অনেক টেন্ডার ভাগাভাগির সঙ্গে জামায়াতের লোকেরা জড়িত। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় জামায়াত।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্নমতের লোকদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য করা হয়েছিল, তা জাতির সঙ্গে মোনাফেকি কি না, বিএনপি নেতা রিজভীর প্রতি এই প্রশ্ন রেখে জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণ এই রাজনৈতিক ছন্দঃপতনের ইতিহাস ভুলে যায়নি। জামায়াত কখনো মোনাফেকির আশ্রয় নেয়নি।

রবিবার রাতেই বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতের এই বিবৃতির স্ক্রিনশট এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ২০১৮ সালের একটি নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দর-কষাকষি করে ২২ আসন বাগিয়ে নেয় জোট থেকে এবং সে নির্বাচনে ডা. শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সঙ্গে জোট? আর কার সঙ্গে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?’

রুহুল কবীর রিজভীর বক্তব্যকে সমর্থন করছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে জামায়াত যে ধরনের কথা বলে আসছে, তাতে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক।

বিএনপির অনেকের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ মেয়াদে শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র নেতাদের কারো কারো বক্তব্য ও তৎপরতার সঙ্গে জামায়াতের যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছে। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জামায়াতের এক ধরনের প্রভাব আছে বলে বলাবলি আছে। নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার, জামায়াত ও ছাত্র নেতৃত্ব—তিন পক্ষ বিএনপি বিরোধী প্রচারণায় নেমেছে। জামায়াতের নেতৃত্বে যে জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, এটিও বিএনপিকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন তাঁরা।

তবে জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনগণ ক্ষুব্ধ হওয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এতে বিএনপির ঈর্ষা হচ্ছে। বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ভেতরে ভেতরে জামায়াতবিরোধী এক ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই দলের সম্পর্কের মধ্যে তিনি নেতিবাচক কিছু দেখছেন না। সম্পর্ক এখনো ঠিক আছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে সবার কথা বলা উচিত। আমরা এমন বিভাজন চাই না, যাতে আওয়ামী লীগ কোনো ধরনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। যাঁরা এসব বিবেচনা করে কথা বলেন না, তাঁরা নানা বক্তব্য দিতে পারেন।’

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। এতে আওয়ামীপন্থীরা ‘বিএনপি-জামায়াত’ একটি রাজনৈতিক অভিধা চালু করেছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হতো বিএনপি ও জামায়াত এক ও অভিন্ন সত্তা, যা সত্য নয়।

বক্তব্য-বিবৃতিতেও বিরোধ

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন না—এমন বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্য নিয়েও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মূলত তখন থেকে দুই দলের মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু।

এর এক দিন পর এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট বলেন, ‘প্রতিশোধ না নেওয়ার মানে হচ্ছে আমরা আইন হাতে তুলে নেব না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তিও হতে হবে।’

এর আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে গত ২৮ আগস্ট ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদা এক অনুষ্ঠানে কথা বলেন জামায়াতের আমির। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগী দেশ আমাদের খুবই প্রয়োজন। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন?’ জামায়াত আমিরের এসব বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বিএনপির।

এসব বক্তব্যের পর সাতক্ষীরায় বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে দেখেছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে। সে কারণে তারা বিভ্রান্ত ছড়ায় এ রকম কিছু কথাবার্তা বলছে।’ এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকারও আহ্বান জানান তিনি।

এ ছাড়া বিএনপির নাম উল্লেখ না করে জামায়াত নেতারা প্রায়ই বলছেন, এক চাঁদাবাজ বিদায় নিয়েছে আর কোনো চাঁদাবাজ দেখতে চাই না। এক স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে, আরেক স্বৈরাচার জনগণ দেখতে চায় না। এত দিন এসব বক্তব্যের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি বিএনপি নেতারা। রবিবার রুহুল কবীর রিজভী কঠোর ভাষায় দলটির সমালোচনা করেন। দলের নেতাদের ধারণা, রিজভী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর প্রতি দলের শীর্ষ নেতার সায় আছে। 

নির্বাচন নিয়ে দুই মেরুতে দুই দল

সংসদ নির্বাচন কবে হবে, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপি যতটা সরব, জামায়াত ততটাই নীরব। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে তেমন তাড়া নেই।

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় অসন্তুষ্টি জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে জামায়াত রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে সরকারকে কোনো চাপ দেয়নি। এ বিষয়ে তারা কৌশলী ভূমিকা দেখাচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পর ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে নির্বাচনের দাবি নিয়ে মির্জা ফখরুল বক্তব্য দেওয়ায় প্রতিক্রিয়া জানান জামায়াত আমির। ওই সময় তিনি বলেন, বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।

এর জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’

তখন থেকে নির্বাচন নিয়ে দুই দলের নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। তবে তাঁরা কেউ দলের নাম উল্লেখ করে কিছু বলেননি। 

টানাপড়েন চলছেই

১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোটের কলেবর বেড়ে হয় ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়। ২০২২ সালের আগস্টে জামায়াতের মজলিসে শুরার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ২০ দলীয় জোট আর কার্যকর নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘পরকীয়া’ করছে জামায়াত।

জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, তাঁদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট; সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।

এর আগে জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে বিএনপি। জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার ও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দলটি। তখনো দুই দলের মধ্যে এক ধরনের বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। যদিও পরে দলের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে মতবিরোধের অবসান ঘটে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d