Bangladesh

বিএবির ব্যানারেই ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায়

বিএবি থেকে চাঁদা তুলে বেশির ভাগ সময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে জমা দেয়া হতো। তবে কখনো কখনো কম্বল কিনে বিতরণ করা হতো। এ কম্বল কিনাতেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে।

ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার পুরো ১৬ বছর চেয়ারম্যানের পদ দখল করে রেখেছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার। পতিত প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত আস্থাভাজন এ ব্যবসায়ী কখনো মুজিব কর্নার, কখনো শেখ পরিবারের প্রতিষ্ঠান সূচনা ফাউন্ডেশন, কখনো প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে হাসপাতাল আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর ভাইদের নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন তহবিলে ব্যাংকগুলোকে শত শত কোটি টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য করতেন। এভাবে ২০১৭ সাল থেকে গত বছরের আগস্টের আগ পর্যন্ত শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই নেয়া হয় সাড়ে চার শ’ কোটি টাকা। এ জন্য তিনি দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি। উপরন্তু শত শত কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে তার বিরুদ্ধে প্রায় ১০টি দেশে অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। গত ১০ বছরে বিএবির ব্যানারে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়ে শেখ পরিবারে অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে তার বিশেষ তদন্ত শুরু করেছে। বিএবির এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিএবির সদস্য গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমরা ধারণা করছি বিএবির ব্যানারে নজরুল ইসলাম মজুমদার গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা চঁাঁদা তুলে শেখ পরিবারকে জোগান দিয়েছেন। তবে তদন্ত শেষ হলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

জানা গেছে, বিএবি থেকে চাঁদা তুলে বেশির ভাগ সময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে জমা দিতেন। তবে কখনো কখনো কম্বল কিনে বিতরণ করতেন। এ কম্বল কিনাতেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এসব কেনাকাটায় নজরুল ইসলাম মজুমদারের ঘনিষ্ঠরা জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। আবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দেয়ার দৃশ্য ধারণ করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। এতেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে মজুমদারের ঘনিষ্ঠ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তবে বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি বিএবি সভাপতি হিসেবে নজরুল ইসলাম মজুমদার পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত গৃহহীনদের জমিসহ ঘর উপহার প্রদান প্রকল্পে প্রতিটি পুরনো ব্যাংককে চার কোটি টাকা এবং প্রতিটি নতুন ব্যাংককে এক কোটি টাকা করে দেয়ার নির্দেশনা দেন। এ সংক্রান্ত এক ভার্চুয়াল সভায় ওই বছরের ১৫ জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে নিজ হাতে চেক বা পে-অর্ডার গ্রহণ করতে প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছে বলে তিনি জানান। মুনাফা কম হলেও নিরুপায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিরা নজরুল ইসলাম মজুমদার নির্দেশিত চেক নিয়ে হাজির হন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রকল্প পরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান ইসলামী ব্যাংকের চার কোটি টাকার প্রাপ্তি স্বীকারোক্তি দিয়ে ২৯ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দেন।

২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে প্রতিটি পুরনো ব্যাংক পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংক এক কোটি টাকা করে প্রদান করে।

২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিএবির এক সভায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য সারা দেশে মুজিব কর্নার প্রতিষ্ঠা করতে বিএবি ১৭টি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকা করে ১৭০ কোটি টাকা, ১১টি ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা করে ৫৫ কোটি টাকা এবং ৯টি নতুন ব্যাংকের কাছ থেকে এক কোটি টাকা করে ৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করে বিএবি।

২০২৩ সালের ১ আগস্ট শেখ মুজিবের কারাগারের রোজনামচা নামক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বিএবি ইসলামী ব্যাংক থেকে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ এর অনুকূলে দু’ কোটি টাকা নেয়া হয়। একই বছর ৯ অক্টোবর বিএবি ইসলামী ব্যাংক থেকে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের অনুকূলে অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের জন্য দুই কোটি টাকা তুলে নেয়।

২০১৭ সালের ৪ মে বিএবির নির্দেশনায় ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের অনুকূলে সাড়ে সাত কোটি টাকা এবং সূচনা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে সাড়ে সাত কোটি টাকাসহ মোট ১৫ কোটি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। একইভাবে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতি জাদুঘর’ এর অনুকূলে ১৫ কোটি টাকা প্রদান করে ইসলামী ব্যাংক। ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল বিএবির নির্দেশনায় পতিত প্রধানমন্ত্রীর মা বেগম ফতিলাতুন্নেছা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া হয় ২৫ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ১১ মে বিএবির এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট ও ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ এর নামে ১৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। ২০২০ সালের ৩ মার্চ প্রতিটি ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রদানের জন্য বিএবি থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। ২০২০ সালের ২৯ মার্চ বিএবি তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রতিটি পুরনো ব্যাংককে পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংকগুলোকে ২০ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল বিএবির আরেক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রতিটি পুরনো ব্যাংকগুলোকে পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংকগুলোকে এক কোটি টাকা করে প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এ দিকে ২০২২ সালের ২৩ জুনের মধ্যে ইসলামী ব্যাংককে ১০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয় বিএবি। বিএবি ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমস আয়োজনের জন্য প্রতিটি পুরনো ব্যাংককে এক কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংকগুলোকে ৫০ লাখ টাকা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। বিএবি ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি পুরনো ব্যাংককে এক কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংককে ৫০ লাখ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়।

২০১৮ সালের ৮ আগস্ট দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উন্নয়নের জন্য বিএবি ২৮টি ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি টাকা তুলে নেয়। একই বছর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে বিএবি ১০০ কোটি টাকা তুলে দেয় ব্যাংকগুলো থেকে। এর মধ্যে পুরনো ব্যাংকগুলোর প্রতিটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন ব্যাংকগুলো প্রতিটিকে দিতে হয় এক কোটি টাকা করে।

এ দিকে ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট বিএবির এক সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে ব্যাংকগুলোকে ১০০ কোটি টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto