Trending

বিক্রি কমে ব্যবসা লাটে

বাজারে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে দফায় দফায় সুদের হার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ কমানোর কৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত। ডলারের উচ্চমূল্য ঘি ঢেলেছে বাজারে। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি, বরং জিনিসপত্রের বাড়তি দামে তারা প্রায় দিশাহারা।

উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতায় কাজ কমেছে সাধারণ মানুষের। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে জনজীবনে অস্থিরতা, আস্থাহীনতা। ছোট-বড় সব বিনিয়োগ বা ব্যবসা প্রসারে স্থবিরতা। নিত্য দিনযাপনে মানুষের মধ্যে অস্থিরতার প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সর্বত্র।

এর ফলে একদিকে যেমন উৎপাদনশীলতায় স্থবিরতা চলছে, তেমনি মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তারা সীমিত করছে কেনাকাটা, যার প্রভাবে বেচাবিক্রিও কমেছে ব্যবসায়। বিশেষ করে খুচরা বিক্রিতে মন্দা চলছে। ব্যবসার এই ভাটার টানে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের ব্যাবসায়িক সক্ষমতা।

তাঁরা আছেন উদ্বেগে।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে একদিকে কারখানায় উৎপাদন যেমন কমেছে তেমনি উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বন্যার নেতিবাচক প্রভাব। এতে বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের চাহিদা কমেছে।

খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চাহিদা বেশি কমেছে। এতে এই খাতগুলোর বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় ব্যবসা লাটে ওঠার পরিস্থিতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাথাপিছু সঞ্চয় বেড়েছে ৩.২৯ শতাংশ। আর ঋণ বেড়েছে ৫.৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সঞ্চয় থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেশি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চ সুদহার তাঁদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে; ঋণের খরচ বাড়ায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে।

মূল্যস্ফীতির হিসাব মিলছে না বাজারে : সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও বাজারে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ। এই হার আগস্টে ১০.৪৯ এবং জুলাইয়ে ১১.৬৬ শতাংশ ছিল।

অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৪০ শতাংশ, যা আগস্টে ১১.৩৬ এবং জুলাইয়ে ১৪.১০ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) সেপ্টেম্বরে ১৩০.৬১, আগস্টে ১২৯.৩৪ এবং জুলাইয়ে ১২৬.০৬ ছিল।

অর্থনীতির মূল চারটি খাত সংকুচিত : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জেরে জুলাই মাসে দেশের অর্থনীতির প্রধান চারটি খাত সংকুচিত হয়েছে। পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স বা পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর নিচে নেমে এসেছে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার ও পলিসি এক্সচেঞ্জের সর্বশেষ পিএমআই সূচকের মান জুলাই মাসে ৩৬.৯-এ নেমে এসেছে; আগের মাসে যা ছিল ৬৩.৯। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দেশে পিএমআই সূচকের মান কমেছে ২৭ পয়েন্ট।

জুলাই মাসে কৃষি খাতের বড় সংকোচন হয়েছে। সূচকের মান কমেছে প্রায় অর্ধেক। উৎপাদন খাতে পিএমআই সূচকের মান ৩৪.১; জুন মাসে যা ছিল ৬১.৭। একইভাবে নির্মাণ ও সেবা খাতেরও সংকোচন হয়েছে। জুন মাসে নির্মাণ খাতের সূচকের মান ছিল ৬৫.১, জুলাই মাসে এই সূচকের মান ছিল ৪৫। অর্থাৎ এক মাসে প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে।

সেবা খাতের পয়েন্ট কমেছে ২৬.৫। জুন মাসে এই সূচকের মান ছিল ৬৩.৫; জুলাই মাসে যা নেমে আসে ৩৭-এ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে, বিনিয়োগে ভাটা চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে গত তিন-চার বছরে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যাগুলো দীর্ঘায়িত হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-পরবর্তী আন্দোলন-বিক্ষোভে বেশ কিছু অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে তিন বছর ধরে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও খুব মন্থর অবস্থায় আছে। সেটাও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ। বাজারে চাহিদা কম। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমার মূল কারণ অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি।’

বিশ্বব্যাংকের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে শিল্পাঞ্চলগুলোতে ঘন ঘন বিক্ষোভ হচ্ছে। অনেক কারখানা সময়মতো বেতন দিতে পারছে না। বেতন থেকেই কর্মীদের পণ্য চাহিদা পূরণ হয়। এতেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জুলাই মাসের আগে বছরখানেক রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল না, যার ফলে রেমিট্যান্সকেন্দ্রিক যে ভোগ ব্যয়, সেটাও কমায় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে ভোক্তাচাহিদা খুব দুর্বল অবস্থায় আছে। এই কারণে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে।’ 

বিক্রি-চাহিদা কমেছে : দেশের বিভিন্ন অংশে আকস্মিক বন্যা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তাঁরা বলছেন, মানুষের মধ্যে এখনো অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে তারা আগের মতো কেনাকাটা করছে না।

বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোক্তার পণ্য চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তুলনামূলকভাবে তারা বড় পণ্যের পরিবর্তে ছোট পণ্য কিনছে। ক্রেতারা পাঁচ লিটারের তেল না কিনে দুই লিটারেরটা কিনছে, হয়তো পাউরুটি ফ্যামিলি সাইজেরটা না কিনে ছোটটা কিনছে। সামগ্রিকভাবে খুচরা বিক্রেতাদের পাওয়া তথ্যে মনে হচ্ছে, বাজারে ভোগ চাহিদা তুলনামূলক কম। ছোট পণ্যের চাহিদা বাড়ার অর্থ হচ্ছে মানুষ কষ্টে আছে, ব্যয় কমাচ্ছে।’

দ্রুত বর্ধমান ভোগ্য পণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে দেশের ভোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। খাদ্য, পানীয়, দুধ, প্রসাধনী, গৃহ পরিচর্যাসহ এমন নিত্যব্যবহার্য পণ্যকে ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস বা দ্রুত বর্ধমান ভোগ্য পণ্য বলা হয়। এসব পণ্য তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় দ্রুত বিক্রি হয়। ফলে দেশের ভোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশ বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার হয়ে উঠেছিল। গত জুলাইয়ের আন্দোলনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের পণ্যের কেনাবেচা বহুলাংশে কমেছে।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, কয়েক জেলায় বন্যা, কেনাকাটা-বিনোদনের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না ফেরাসহ নানা কারণে এফএমসিজির বাজারে বিক্রি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

নির্মাণসামগ্রী বিক্রিতে ভাটা : নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অস্বাভাবিক হারে রড ও সিমেন্ট বিক্রি কমেছে। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো পুরোদমে চালু না হলে রড ও সিমেন্ট খাত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) জানায়, দেশে ছোট-বড় ইস্পাত কারখানা রয়েছে ২০০টির মতো। এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪০টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। যদিও দেশে বার্ষিক রডের ব্যবহার ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এখন পর্যন্ত এই খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। বছরে লেনদেনের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের এমডি শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে এই খাত। বাজারে রডের চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এফএমসিজিতে নেতিবাচক ধারা : ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডসের (এফএমসিজি) বিক্রিতেও নেতিবাচক ধারা চলছে। কম্পানিগুলো জানিয়েছে, ভোজ্য তেল, নুডলস, চা, দুগ্ধপণ্য, কোমল পানীয়, পার্সোনাল কেয়ারসহ বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে তাদের বেচাকেনা ভালো যাচ্ছে না।

দেশের একটি শীর্ষ এফএমসিজি কম্পানি জানিয়েছে, গত দুই মাসে সব ক্যাটাগরিতে তাদের বিক্রি কমেছে। বিশেষ করে সাবান, শ্যাম্পু, ক্রিমসহ ব্যক্তিগত যত্নের আইটেম বিক্রি বেশি কমেছে। ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য অনেক ভোক্তা সস্তা ব্র্যান্ড বা ছোট প্যাক বেছে নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি গ্রাহকদের ব্যয়ের অভ্যাসে এই পরিবর্তন এনেছে।

রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আগে ক্রেতারা যে পরিমাণে পণ্য কিনত, এখন তার চেয়ে কম কিনছে। মানুষ এখনো মানসিকভাবে সাম্প্রতিক অস্থিরতা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। এ কারণে অনেকে কাজ হারিয়েছে, অনেকে হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অনেকের বাড়তি আয় বন্ধ। এ কারণে খরচ সাশ্রয়ে মনোযোগী হয়েছে বেশির ভাগ পরিবার।

রাজধানীর রামপুরার মুদি দোকানদার জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সংসারের খরচ বাঁচাতে অনেকেই বাচ্চাদের দুধ কেনাও কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা নিয়মিত তরল দুধ কিনত, তারাও এখন দু-তিন দিন পর পর কিনছে। মানুষ এখন খরচ কমিয়ে হাতে কিছু টাকা রাখতে চাচ্ছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor