বিচারে সবাই একমত, নিষিদ্ধে দলগুলোর না
- ‘নির্বাচনে আসতে হলে নতুন নেতৃত্বে আসতে হবে’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দলটির রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে জোরালো আলোচনা তৈরি হয়েছে। সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে একমত। তবে দলটিকে নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচন থেকে বিরত রাখার পক্ষে নয় দলগুলো।
এরই মধ্যে হত্যা, গুমের মতো অপরাধে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুপারিশের বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মনে করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এটা ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে। বলেছে, সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতিমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন।
তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি নেই, সাক্ষাৎকার এমন প্রশ্ন করা হলে ড. ইউনূস বলেন, ‘কোনো একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নেওয়ার জন্য আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি।’
মঙ্গলবার জাতীয় জাদুঘরে ‘কী চাই নতুন বাংলাদেশে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার হবে। যাদের হাতে শহীদদের রক্ত, তাদের বিচার হওয়ার আগে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যা আর অপরাধের বিষয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধ নেই, ক্ষমা চাওয়ার লক্ষণ নেই। উল্টো পুলিশ হত্যার বিষয়টি সামনে এনে তারা গণহত্যার অপরাধের বাইরে আলাদা বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিচার হতেই হবে।’
একই অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়, তারা সাবধান হোন। আগে আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে। তারপর রাজনীতিতে আসতে পারবে কি পারবে না, সেটা নির্ধারণ হবে।’
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এ আন্দোলনে হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে বলা হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।
এ হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ অথবা দল হিসেবে নির্বাচনে বিরত রাখার পক্ষে নয় বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল। তারা মনে করে, দলের যারা অপরাধী অথবা অপরাধ সংঘটিত হতে সহায়তা করেছে, তাদের বিচার করা হোক। দল হিসেবে তাদের বিচার কী হবে, এটি ছেড়ে দিতে হবে জনগণের ওপর।
রাজনীতিকদের যুক্তি হলো- আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে উল্টো জনগণের সহানুভূতি পাবে দলটি। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন বলেন, ‘বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিচার চায়, তবে নিষিদ্ধ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত জনগণ নেবে।’
বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যারা যুক্ত, যারা নির্দেশদাতা এবং কোনো না কোনোভাবে জড়িত তাদের বিচার করতে হবে ট্রাইব্যুনালে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা কাউকে নিষিদ্ধের পক্ষে না। কোনো একটা রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ না দিতে দেওয়া বা নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান হতে পারে না।’
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং ১৬ বছর যে অপরাধ কর্মকাণ্ড করেছে; তাতে তাদের রাজনীতিতে ফেরার কোনো সহজ রাস্তা নেই। দলটির নেতৃবৃন্দকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্ন আছে। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ফিরতে হলে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে। দলটির নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠন করতে হবে।’ তবে সাইফুল হক বলেন, ‘আমি কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা সমাধান মনে করি না। নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে অপরাধ ঢাকা পড়ে যায়।’
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনূস বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য দেখে মনে হলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচনে অবৈধ ঘোষণা করা নিয়ে সংকোচ বোধ করছেন। বিএনপির বক্তব্যও দেখেছি, তারা হয়তো তাদের দলীয় স্বার্থে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। যাদের বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে, তাদের রাজনীতিতে না থাকাই ভালো। আওয়ামী লীগের সবাই খারাপ তা বলছি না। যেসব ভালো মানুষ রয়েছে তারা যদি গুছিয়ে নির্বাচনে আসতে পারে, আসবে।’