Hot

বিচার বিভাগ পৃথক করার সুফল মেলেনি ১৭ বছরেও, লক্ষ্য পূরণে ১২ দফা নির্দেশনা কার্যকর হয়নি এখনও

আজ ১ নভেম্বর, বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণ দিবস। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় অনুসারে ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় বিচার বিভাগকে। ওই রায়ে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের লক্ষ্য পূরণে ১২ দফা নির্দেশনা দিলেও তা সম্পূর্ণভাবে আজও কার্যকর হয়নি। পৃথক্‌করণের সময় দেশে সাড়ে ১৫ লাখ মামলার জট থাকলেও বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪৪ লাখে। ফলে পৃথক্‌করণের সুফল এখনও অধরা রয়ে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার এবং এর স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক কমিশন গঠন করেছে। উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠনের জন্য ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। কয়েক মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠন হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইন বিশেষজ্ঞ ও বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ মনে করেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে সরকারের ইচ্ছা অনুসারেই রায় বা আদেশ প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ ধারণা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন গঠন, বিচার বিভাগের অধীনে নিজস্ব সচিবালয় গঠন, মামলা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। সংস্কার কমিশনকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।

একাধিক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, বিচার বিভাগে পদ সৃজন থেকে শুরু করে বাজেট-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় আইন মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের অন্যান্য বিভাগে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয়। সেখানে তা দীর্ঘদিন ধরে ফাইলবন্দি হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগিদ দিয়েও কাজের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। আবাসন, পরিবহনসহ অনেক বিষয়ে বিচার বিভাগ এখনও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য বিচার বিভাগের নিজস্ব বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা নিশ্চিত করা জরুরি।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত ছিল। পরে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট, অর্থাৎ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ফলে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পায়। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকলে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের উদ্দেশ্য সম্পন্ন হবে। তা ছাড়া বিচার বিভাগের অধীনে নিজস্ব সচিবালয় এবং বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা থাকাটাও জরুরি।

অর্থনৈতিকসহ নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে জেলা জজ ও তৎকালীন জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাসদার হোসেন ১৯৯৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। আবেদনের পক্ষে ১৯৯৭ সালে রায় দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে ১৯৯৯ সালে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে ৩০১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নিয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।

বর্তমানে অধস্তন আদালতে ২ হাজার ৮১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা আছেন। উচ্চ আদালতের দেওয়া ১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে গত ১৭ বছরে সাত-আটটি নির্দেশনা আংশিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুসারে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন ও এর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তবে ১২ বছরেও চিঠির কোনো জবাব মেলেনি। বরং পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রয়োজন নেই বলে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এরই মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে ফের চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা সমকালকে বলেন, ‘মাত্র কয়েক দিন হলো চিঠি পাঠানো হয়েছে। অগ্রগতির বিষয়ে কোনো মতামত এখনও পাইনি। তবে আমরা আশাবাদী।’ 

জানা গেছে, পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়ে সরকার ইতিবাচক। সম্ভাব্য নানা দিক পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। বিচার বিভাগের সার্বিক বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান বলেছেন, আদালতের কার্যক্রমে ত্রুটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান। নানা বিষয়ে কীভাবে স্বস্তি দেওয়া যায়, এ নিয়ে কমিশন সুপারিশ করবে। বিস্তারিত কমিশনের সুপারিশে তুলে ধরা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button