Bangladesh

বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পাঁয়তারা, ক্ষোভ বাড়ছেই

চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণে ২০ বছর আগে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়। টার্মিনালটিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে ব্যয় করা হয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এখানে জাহাজ থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ চাহিদার চেয়ে ১৬.৬৭ শতাংশ বেশি। সক্ষমতার চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি কনটেইনার ওঠানামা করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ এই টার্মিনাল দিয়েই হয়েছে। আয়ও বেড়েছে ২৩.৩৬ শতাংশ। এত কিছু থাকার পরও বন্দরকে আরো এগিয়ে নিতে কিছু টার্মিনাল এবং প্রকল্প বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সরকারের ইচ্ছা নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চট্টগ্রামে এরই মধ্যে মশাল মিছিল, অবস্থান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

এনসিটির ব্যবস্থাপনা বিদেশি কম্পানিকে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছেন যুব অর্থনীতি ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হাসান। রিটের শুনানি হতে পারে আগামী রবিবার।

জানা যায়, ২০০৭ সালে এনসিটির নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়। পরে এটি বাতিল করা হয়।

বন্দর তখন নিজস্ব তহবিল থেকে টার্মিনাল সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং স্থানীয় অপারেটর নিয়োগ করে। নির্মাণের আট বছর টার্মিনালটি অব্যবহৃত ছিল। ২০২২ সালের মধ্যে এনসিটির মূল সরঞ্জাম স্থাপন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এনসিটিতে একজন বিদেশি অপারেটর নিয়োগের আলোচনা তখন শুরু হয়।   ২০২৩ সালের মার্চে সরকার এনসিটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)।

২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভায় প্রকল্পের টাইমলাইন ঠিক করা হয়। নথি অনুযায়ী, চলতি মে মাসের মাঝামাঝি আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট (টিএসআর) দেবে। প্রতিবেদন অনুমোদনের পর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। দর-কষাকষি করে নভেম্বরে কনসেশন চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্প অনুযায়ী, চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাসুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড। একটি পক্ষ মনে করছে, বন্দর পরিচালনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের রয়েছে বিশ্বমানের দক্ষতা। এনসিটিতে খুব বেশি বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলেও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।

গত ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামে বলেছেন, বিশ্বের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর অনেক পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের হাতে যেভাবেই হোক বন্দর ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে মানুষকে এটা বোঝাতে হবে।

এই বক্তব্যের পর চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের না দিতে চট্টগ্রামে নিয়মিত প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতে ইসলামী, চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটি, চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, চট্টগ্রাম বন্দর ইসলামী শ্রমিক সংঘ, গণ অধিকার পরিষদ, জুয়েলারি সমিতি চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সংগঠন।

চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক দল বিদেশি অপারেটর নিয়োগ বাতিলে আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬ মে প্রতিবাদ কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করছে। বন্দর বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষের একার ওপর নির্ভর করে না। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল পরিচালনাকারী সরকারি সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ ছাড়া বন্দরের অভ্যন্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সরকারি সংস্থাও বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত। পাশাপাশি বেসরকারি খাত, যেমন—কনটেইনার পরিচালনা, নিরাপত্তা, পণ্য হ্যান্ডলিং, শিপিং এজেন্ট, কার্গো এজেন্ট ও ফ্রেট ফরোয়ার্ডাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সংস্কার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে সামগ্রিক। নিশ্চিত করতে হবে সব পক্ষের কার্যকর সমন্বয়।

বন্দর বাঁচাও আন্দোলনে সক্রিয় জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের (বন্দর ইউনিট) সাবেক প্রচার সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনালটিকে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করতে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এখন আর বিনিয়োগ করার মতো তেমন কিছু বাকি নেই এনসিটিতে। ২০০৭ সাল থেকে স্থানীয় সংস্থা সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড এনসিটির দুটি জেটি অ্যাডহক ভিত্তিতে পরিচালনা করে আসছিল। ২০১৫ সালে বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে চারটি জেটির অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। যদি নতুন অপারেটর নির্বাচন করতে হয় তবে তা একটি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছভাবে করা উচিত। এনসিটি বিদেশি অপারেটরের কাছে ইজারা দিলে একটি সম্পূর্ণ চালু টার্মিনাল থেকে রাজস্ব চলে যাবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আনার কারণ হচ্ছে বিনিয়োগ পাওয়া ও দক্ষতা বৃদ্ধি। কিন্তু নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে নতুন করে এসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ যেমন নেই, তেমনিভাবে পাশেই নৌঘাঁটি থাকায় এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী ইমাম মাহমুদ বিলু বলেন, ‘এনসিটি যথেষ্ট সক্ষম। সেটা কেন বিদেশিদের হাতে যাবে?’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto