Hot

বিদেশি ঋণ দুই বছরে বেড়ে হবে দ্বিগুণ

বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্কলন হলো, আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) এ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আসল ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি এবং সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মানে দুই বছরের মাথায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হবে। ক্রমবর্ধমান পরিশোধের চাপ মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে সরকারকে। 

সরকারের পক্ষে বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধের দায়িত্বে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি। পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকায় সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্ধারিত ব্যয়সীমা ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। ইআরডি সচিব মো. শাহ্‌রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদেশি ঋণের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অধিক হারে বৈদেশিক ঋণ আহরণ করা হয়েছে। ফলে পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাছাড়া নতুন ঋণের পরিশোধও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। 

ইআরডির চিঠিতে জানানো হয়, বর্তমানে গৃহীত বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস, যা আইএমএফের মুদ্রা)। ঋণ পরিশোধ করতে হয় সাধারণ মার্কিন ডলার ও ব্রিটিশ পাউন্ডে। এসডিআরের সঙ্গে ডলার ও পাউন্ডের বিনিময় হার ও ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের তারতম্য এবং ডলার ও ইউরোর বেঞ্চমার্ক রেট বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাঁদা বা শেয়ার মূলধন বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। তাই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ইআরডির অনুকূলে নির্ধারিত ব্যয়সীমা বাড়ানোর দাবি করা হয় চিঠিতে। 

চিঠির সঙ্গে শাহ্‌রিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার কার্যবিবরণী সংযুক্ত করা হয়। এতে উল্লেখ রয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ইআরডির অনুকূল উন্নয়ন, পরিচালন এবং বিশেষ কার্যক্রমে ব্যয় বাবদ মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৩৭ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জন্য বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের প্রাক্কলন ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য ৪১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকার মধ্যে আগামী বাজেট প্রণয়নে ইআরডিকে সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

কিন্তু ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের বর্তমান ধারা ও আগামীর চাহিদা পর্যালোচনা করে ইআরডি বলছে, এ ব্যয়সীমার মধ্যে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব নয়। কারণ বিদেশি ঋণ-সংক্রান্ত দায় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগামী বছরগুলোতে তা আরও বাড়বে। 

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয় ৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পরের দুই অর্থবছর এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ হচ্ছে যথাক্রমে ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি এবং ২৪ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।  

এদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ গত ২০২১-২২ অর্থবছর ব্যয় হয় ১৩ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর কিস্তি পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পরের দুই অর্থবছর এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ হচ্ছে যথাক্রমে ৪১ হাজার ৩৫৯ কোটি এবং ৪৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। 

বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নেওয়া বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আট বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিদেশি ঋণের বড় অংশ (৭৭ শতাংশ) সরকারি খাতের। ঋণের দায় পরিশোধ চলমান সংকটে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

সাবেক অর্থ বিভাগ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, সংগত কারণে বাজেট সংকোচনমূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য গত এক দশকের বেশি সময় আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর ফলে সরকারের ওপর বিদেশি ঋণের দায় বেড়েছে, যা অর্থনৈতিতে সংকট তৈরি করেছে। তারপরও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি। তবে আগামীতে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এভাবে ঋণ নিয়ে সংকট আরও বাড়াবে নাকি রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখনও সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ হার প্রায় ২২ শতাংশ। তবে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সার্বিকভাবে রাজস্ব বাড়াতে না পারলে বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ ডেট সাসটেইনেবল অ্যানালাইসিস অনুযায়ী বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কম ঝুঁকিতে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, জিডিপি নয় বরং রাজস্ব আয়ের অনুপাতে ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ ঋণ পরিশোধে টাকা কিংবা ডলার প্রয়োজন। তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের হার অত্যন্ত কম। রাজস্ব আয়ের অনুপাতে বাংলাদেশের ঋণ ৩৮০ শতাংশের মতো। সার্বিকভাবে ঋণের দায় পরিশোধ দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থনৈতিক ধীরগতি শিগগির কাটছে না– এমনটি ধরে নিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে বাজেট সংশোধন হচ্ছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দিয়ে মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও সংকোচনমূলক বাজেট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আলোকে নির্ধারিত ব্যয়সীমার মধ্যে থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বাজেট প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ইআরডি ব্যয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d