বিদেশ যেতে না পেরে দুর্ভোগে কর্মীরা: বিএমইটির স্মার্ট কার্ড জালিয়াতি
বিদেশে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ভুয়া স্মার্ট কার্ড ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এতে বিদেশ যেতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কর্মীদের। সম্প্রতি এমন ১১টি নকল স্মার্ট কার্ড ধরা পড়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কে। এসব কর্মীর বিদেশযাত্রা বাতিল হয়ে যায়।
আটকে পড়া কর্মীরা বলছেন, তাঁরা নিয়ম মেনে টাকা দিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করার পরও স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির কারণে ভোগান্তির শিকার। এমনটি যাতে আর না ঘটে, এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি তাঁরা অনুরোধ জানিয়েছেন। বৈধভাবে বিদেশ যেতে অনুমোদন হিসেবে বিএমইটির স্মার্ট কার্ডের প্রয়োজন হয়। কার্ডটি পেতে কর্মীদের প্রথমে বিএমইটিতে নিবন্ধন করতে হয়।
কিন্তু বিএমইটির নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে কর্মীদের বিদেশ পাঠাচ্ছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা যায়, গত ২৯ মার্চ, ১ এপ্রিল ও ২ এপ্রিল সৌদি আরবের উদ্দেশে যাত্রাকালে ১১ জন কর্মীর স্মার্ট কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত হয়। যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, একটি স্মার্ট কার্ডও বিএমইটিতে নিবন্ধিত নয়। তারা এসব কর্মীর পাসপোর্ট জমা রেখে তাঁদের যাত্রা বাতিল করে।
প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা যায়, এসব কর্মী রিক্রুটিং এজেন্সি এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৪৬৯), সাউন্ড লাইনস (আরএল-১৬৫১) ও মুসা ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-৮৫৭) মাধ্যমে সৌদি যাচ্ছিলেন। পাসপোর্ট আটকে রেখে তাঁদের যাত্রা বাতিল করে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক এই এজেন্সিগুলোর নামে প্রতিবেদন তৈরি করে।
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘এখন বিএমইটি কার্ড জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে। অসাধু চক্র অন্যের ছবির জায়গায় ভুক্তভোগীদের ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা করছে। পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, বিএমইটিতে ওই কর্মীদের কোনো নিবন্ধন নেই।
বিএমইটি থেকে এ বিষয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
বিদেশ যেতে না পেরে দুর্ভোগে কর্মীরা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বাসিন্দা মো. হাফিজের ভাষ্য, সৌদি যাওয়ার উদ্দেশ্যে জমি বেচে ও সুদে ঋণ করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করেন। কিন্তু সৌদি যেতে না পেরে এই ঋণ যেন তাঁর ওপর একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই ভোগান্তির কথা জানান ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার বাসিন্দা বেলাল আহমেদ। তিনি রিক্রুটিং এজেন্সি এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সৌদি যাচ্ছিলেন। এ জন্য দিতে হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। বেলাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে বলা হয়েছে, স্মার্ট কার্ডে সমস্যা হওয়ায় আমরা যেতে পারব না। তারা বলছে, এজেন্সির নামে অভিযোগ রয়েছে। কী অভিযোগ, সেটি আমাদের বলেনি। এরপর আমাদের একটা কাগজ দিয়েছে। কাগজের মধ্যে লেখা—অভিযোগ থাকায় এই যাত্রীদের যাত্রা বিচ্ছিন্ন করা হলো।’
এই জালিয়াতির বিষয়ে কথা বলার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল, সাউন্ড লাইনস ও মুসা ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এই যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা যায়, সাউন্ড লাইনস ও মুসা ইন্টারন্যাশনাল একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। তবে এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো. আনোয়ার হোসেন ও সাউন্ড লাইনসের স্বত্বাধিকারী তাসফিয়া কলিমকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয় কিছুই জানেন না বলে জানান মুসা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ব্বাধিকারী মো. মুসা কলিম। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয় কোনো তথ্য বা অভিযোগ পাইনি। তাই আমি এ বিষয় কিছু বলতে পারব না।’
সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিএমইটি সার্ভার
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, স্মার্ট কার্ড জালিয়াতি বন্ধে গত জানুয়ারিতে সার্ভার সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএমইটি। তবে গত চার মাসেও এই সার্ভার সরানো হয়নি। সার্ভারটি এখনো বিএমইটি কার্যালয়ে রয়েছে।
অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএমইটিতে সার্ভারের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এই সার্ভারটি অনেক পুরনো সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনায় তৈরি। এ জন্য জালিয়াতিও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, তারা এই জালিয়াতি বন্ধে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় সার্ভার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) কাছে স্থানান্তর করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে এই সার্ভারের ৩ শতাংশের ১ শতাংশ তথ্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি তথ্যগুলো শিগগরিই সরিয়ে নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমেদ মোজাফফর বলেন, ‘আমরা যেকোনো ধরনের জালিয়াতির বিরুদ্ধে কাজ করছি। স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির তথ্য পেলেই আমরা তদন্ত করছি। এর পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। জালিয়াতি বন্ধে আমরা সার্ভার সরিয়ে নিচ্ছি।’
বেকায়দায় পড়া কর্মীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে যদি স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া যায়, তবে আমরা এর তদন্ত করি। যে কর্মীরা স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির কারণে আটকা পড়ছেন, তাঁদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ফের সব কিছু ঠিক করে পাঠানোর দায়িত্ব নেবে।’