Bangladesh

বিদ্যুতে অপরিশোধিত বিল ৬০ হাজার কোটি টাকা

সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি, আদানিসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ গত জানুয়ারি শেষে অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।

এ অবস্থায় সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট ভর্তুকির প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা গত মার্চ থেকে পরবর্তী চার মাসে পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। মার্চের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে ভর্তুকির অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় করার অনুরোধ ছিল। 

কিন্তু সরকারের কোষাগারে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় গত ২৮ মার্চ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পর এ খাতে আর কোনো অর্থ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর স্থানীয় ঋণের বিপরীতে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করার পাশাপাশি ভর্তুকি বাবদ অর্থ ছাড় করা হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দের এখনও অবশিষ্ট রয়েছে ১৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। 

জানা গেছে, গত জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি, আদানিসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মোট অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া একই সময়ে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ও দেশীয় আমদানিনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত বিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে কয়েক দফা দামও বাড়ানো হয়। এ কারণে আশা করা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি চাহিদা কমবে। কিন্তু উল্টো বিদ্যুতে ভর্তুকির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। গত জুন শেষে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বকেয়া দাঁড়ায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। 

আমদানিকারক ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে দামে সার কেনা হয়, তার চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি হয় বাজারে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও তা-ই। মাঝখানের পার্থক্যটুকু ভর্তুকি দেয় সরকার। কিন্তু গত অর্থবছরে ভর্তুকি চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়া এবং তার আগের অর্থবছরের বকেয়া থাকায় সার ও বিদ্যুৎ খাতের সব পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি সরকার।

নগদ অর্থে পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ায় বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে দায় পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণের বিপরীতে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত রয়েছে।

বিদ্যুতের ভর্তুকির দায় পরিশোধে পরবর্তী পরিকল্পনা বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই বকেয়াসহ সব ভর্তুকি পরিশোধ করার লক্ষ্য ছিল সরকারের। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান না থাকায় অর্থবছরের ৯ মাস পার হয়ে গেলেও বিশেষ বন্ডসহ বিদ্যুতে নগদ ভর্তুকি বাবদ মোট ১৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এমনকি অবস্থা এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, চলতি অর্থবছরের দায় মেটাতে গিয়ে আগামী বাজেটে এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। 

এ বিষয়ে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করে মূলত ব্যক্তি খাতভিত্তিক প্রতিযোগিতাহীন বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন হয়েছে। এতে করে বিনিয়োগকারীদের ইচ্ছা মতো ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ দিয়ে বিদ্যুতের অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়ে প্রায় প্রতি বছর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও ভর্তুকির লাগাম টানা যাচ্ছে না। এখন দেশে গড়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১২ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ৭ টাকা ৮৩ পয়সায় আমদানি করা হচ্ছে। আমদানি থেকে নিজের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি হলে এ শিল্প টিকে থাকতে পারে না। এটাই হচ্ছে আমাদের বিদ্যুৎ শিল্পের পরিণতি। 

এ থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য সরকারের মালিকানায় এ খাতের উন্নয়ন হতে হবে। এ খাতকে সেবা খাত হিসেবে গণ্য করে নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিল করতে হবে। গণশুনানির ভিত্তিতে আরও কার্যকরভাবে বিআরসিকে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা দিতে হবে। 

এদিকে বাজেটে ভর্তুকি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমিয়ে সে অর্থ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে ব্যয়ের পরামর্শও দিয়ে আসছে বৈশ্বিক সংস্থাটি। কিন্তু সরকার আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে উল্টো ভর্তুকি বাড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ চলতি বাজেটের চেয়ে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে আগামী বাজেটে ৪০ হাজার কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভর্তুকির চাপ কমিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই ভোক্তা পর্যায়ে কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তার পরও এ খাতে ভর্তুকির চাহিদা সেভাবে কমেনি। তাই চলতি বরাদ্দ দিয়ে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। 

গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়ার আগে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যৌথভাবে সংস্থাটিকে জানিয়েছিলেন, তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি কমানো হবে। এজন্য সরকারকে স্বাগত জানায় আইএমএফ। 

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খাদ্যে ও কৃষিতে ভর্তুকি রেখে অন্যগুলো থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের ঋণ পেতে শ্রীলঙ্কা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে না। এ ঋণ কর্মসূচি সম্পন্ন করতে হলে বাংলাদেশকেও দাম বাড়াতে হবে। তবে ধাপে ধাপে দাম বড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d