Bangladesh

বিদ্যুতে ভর্তুকি বন্ধ করলে দাম বাড়বে ৭৮ শতাংশ

ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করতে বলছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সরকারও এ খাতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড একটি পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা গেছে, ভর্তুকি তুলে নিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। সংস্থাটির সুপারিশ হচ্ছে, ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করলে জনগণের জন্য সহনীয় হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, লোকসান কমাতে মূল্য কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জ্বালানির মূল্য অপরিবর্তিত থাকলে দু-তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসানের ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে। 

২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আমদানি করা জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামও বেড়েছে। তাই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বেড়েছে গ্রাহক পর্যায়ে দামও। শুধু ২০২৩ সালে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। 

সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইএমএফ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে এ অর্থ। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার এবং ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করার কথা আগামী জুনে। এর আগে যেসব খাতে সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি যৌক্তিক করা। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবি সরকারের কাছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা ভর্তুকি চায়। গত অর্থবছরে (২২-২৩) তা আরও বেড়ে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছে। 

পিডিবির পর্যালোচনা 
বিদ্যুতের বর্তমান গড় খুচরা দাম ৮ টাকা ২৫ পয়সা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭০ পয়সা। ভর্তুকি শূন্য করতে হলে পাইকারি দাম বাড়িয়ে ১২ টাকা ১১ পয়সা করতে হবে। তখন গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়ে হবে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা। 

ভর্তুকিশূন্য করতে দাম সমন্বয়ের চারটি ধাপ তুলে ধরেছে পিডিবি। প্রথম ধাপের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫ শতাংশ হারে পাইকারি দাম বাড়াতে হবে। এতে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ খাতে কোনো ভর্তুকি দিতে হবে না। এ ক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১ শতাংশ, মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৪ শতাংশ হারে এবং ডিসেম্বরে ১০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপে পিডিবি দেখিয়েছে, ভর্তুকি তুলে নিতে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০ শতাংশ হারে পাইকারি দাম বাড়াতে হবে। এতে আগস্ট থেকে আর ভর্তুকি লাগবে না। এতে খুচরা পর্যায়ে দাম ফেব্রুয়ারিতে ১৫ শতাংশ, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৯ শতাংশ হারে এবং জুলাইয়ে ১১ শতাংশ বাড়াতে হবে। 

তৃতীয় প্রস্তাবনায় পিডিবি বলেছে, ভর্তুকি শূন্যে নামাতে ফেব্রুয়ারি, মে, আগস্ট ও নভেম্বরে ১৬ শতাংশ করে পাইকারি দাম বাড়াতে হবে। নভেম্বর থেকে আর ভর্তুকি লাগবে না। সে ক্ষেত্রে গ্রাহক পর্যায়ে ফেব্রুয়ারিতে ২১ শতাংশ এবং মে, আগস্ট ও নভেম্বরে ১৪ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। 

চতুর্থ ধাপে সংস্থাটি দেখিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে ৪০ ও জুলাইয়ে ৩০ শতাংশ দাম বাড়ালে ভর্তুকি শূন্যে নামবে। এ ক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে ফেব্রুয়ারিতে ৪২ শতাংশ ও জুলাইয়ে ২৫ শতাংশ দাম বাড়াতে হবে।

কয়লার ব্যবহার বাড়ছে 
পর্যালোচনায় পিডিবি বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার খানিকটা কমবে। কয়লায় উৎপাদন ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি অর্থবছর ২৩ ও আগামী অর্থবছর ২৮ শতাংশ হবে বলে মনে করছে পিডিবি। ভারত থেকে বিদ্যুতের আমদানি বেড়ে ১২ শতাংশ থেকে চলতি অর্থবছর ১৭ শতাংশ ও আগামী অর্থবছর ১৮ শতাংশ হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের ব্যবহারও কমবে। গত অর্থবছর তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ২৪ শতাংশ বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরে তা কমে হবে ৮ শতাংশ।
পিডিবি ধরে নিয়েছে, গ্যাসের বর্তমান দাম প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা ও দেশীয় কয়লার দাম প্রতি টন ১৮৫ ডলার অপরিবর্তিত থাকবে। আমদানি করা কয়লার দাম চলতি অর্থবছর প্রতি টন ১৩৫ ডলার ও আগামী অর্থবছর ১৫০ ডলার ধরা হয়েছে।

চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৯ ও আগামী অর্থবছর ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ ধরেছে পিডিবি। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। 

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভর্তুকির সুফল পান মূলত ধনীরা। কারণ, তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বেশি ভোগ করেন। তাই দাতাগোষ্ঠীগুলো ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু এতে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এজন্য একদিকে যেমন ভর্তুকি কমাতে হবে, অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বাড়াতে হবে। এতে ভর্তুকিশূন্য হলে প্রান্তিক পর্যায়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা ভিন্ন নামে সেই ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে ভর্তুকি কমানোর ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান নয়, খরচ কমাতে হবে। অপচয়, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে যে বাড়তি খরচ হচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গত এক দশকে বিদ্যুতে যেসব চুক্তি হয়েছে এর অধিকাংশই অতিমূল্যায়িত হয়েছে। ভুল নীতির কারণে বসে থেকে অনেক কেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু লিস্টকস্ট লোড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। এই দিকগুলোতে পিডিবিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু এসব কাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ তেমন নেই। কারণ, এতে মধু কম।’

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এজন্য পিডিবিকে একটি পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। কীভাবে জনগণের ওপর বোঝা না চাপিয়ে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান কমানো যায়, তাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি দাম বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button