Bangladesh

বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে আবারও স্বপ্নবিলাসী মহাপরিকল্পনা

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ায় বছরজুড়ে অলস পড়ে থাকে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। উৎপাদনে না থাকলেও কেন্দ্রগুলোকে দিতে হয় ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)। গত ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে পকেটে ভরেছেন বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ভুল পরিকল্পনার কারণে এই মাশুল গুনছে সরকার। চাহিদার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কারণে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের নতুন মহাপরিকল্পনায় (মাস্টারপ্ল্যান ২০২৩-আইইপিএমপি) ২০৫০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৭১ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতা হতে পারে ১ লাখ ১১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৫৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। এ সময় দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি ঘনফুট।

এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৩০০ বিলিয়ন ডলার খরচ ধরা হয়েছে। জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ধরে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা একে অতি উচ্চাভিলাষী মাস্টারপ্ল্যান হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন, এমন অবাস্তব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অলস বসে থাকার প্রবণতা আগামীতে আরও বাড়বে, যা একটি খারাপ আর্থিক বোঝা তৈরি করবে।

এলএনজিনির্ভর সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান
বিদ্যুৎ খাতে প্রথম মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয় ১৯৮৫ সালে। এর পর ১৯৯৫, ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৬ সালে তা হালনাগাদ করা হয়। এক পর্যায়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত মিলিয়ে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা করা হবে। এ কাজে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এর আগেও একাধিক মহাপরিকল্পনা জাইকার সহযোগিতায় হয়েছে।

নতুন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূল জ্বালানি হিসেবে গ্যাসকেই রাখা হয়েছে। ২০৪১ সালে এ গ্যাস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসার কথা বলা হয়েছে। ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনায় গ্যাসের অংশ ছিল ৪৩ শতাংশ। গ্যাসের জোগানের জন্য মূলত আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজির ওপরই নির্ভর করতে হবে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। দেশি কূপগুলোতে এখন গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে দৈনিক ২১০ কোটি ঘনফুট। মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন অনুসারে স্থলে ও সমুদ্রে সব ধরনের উন্নয়ন ও অনুসন্ধান শেষে ২০৪১ সালের দিকে দেশি গ্যাসের সরবরাহ দাঁড়াবে দিনে ১৭০ কোটি ঘনফুট। সে সময় দেশে গ্যাসের চাহিদা হবে ৪০০ কোটি ঘনফুট। বাকি চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে। কয়লার অংশ ছিল ৩২ দশমিক ২ শতাংশ। এবারে মাস্টারপ্ল্যানে তা প্রায় অর্ধেক হয়ে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

নতুন পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যদিও এ পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বদলে ‘ক্লিন এনার্জি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ মিলছে। মাস্টারপ্ল্যান ২০২৩ অনুসারে ২০৪১-এর মধ্যে ক্লিন এনার্জি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে। নতুন মহাপরিকল্পনায় সৌর (১৫ শতাংশ), বায়ু (১০ শতাংশ), পরমাণু শক্তির (৬ শতাংশ) পাশাপাশি হাইড্রোজেন (৬ শতাংশ) ও এমোনিয়ার (২ শতাংশ) মতো অপ্রচলিত জ্বালানির অংশ রাখা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছিলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে গ্যাস ও কয়লা অব্যাহত রাখলে খরচের বোঝা বাড়বে।

বসে থাকবে অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র
বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট। ৯ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ৯ হাজার ৮৪৯ মেগাওয়াট। আর দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল ১৫ হাজার ৬৮৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বছরজুড়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে।

২০২১ সালে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত ছিল। ২০৩০ সালে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮৭ মেগাওয়াট। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকবে ৪১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট; চাহিদার চেয়ে যা ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।

২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট। এ চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা রাখতে বলা হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি।
এবারের মাস্টারপ্ল্যানে ধরা হয়েছে– ২০৫০ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হবে কয়লার, ৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট জ্বালানি তেলের, ২৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট গ্যাস ও এলএনজির, ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের, ১ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ, ২০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ, ৬ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ, ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হাইড্রোজেন ও ৫ হাজার মেগাওয়াট অ্যামোনিয়াভিত্তিক এবং ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট আমদানি করা হবে।

বিনিয়োগ
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ৩০০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। যেখানে গত ১৩ বছরে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে বলে সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

মাস্টারপ্ল্যানে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জ্বালানি অবকাঠামো খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১৭৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এলএনজি ও গ্যাস অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ লাগবে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, চাহিদা না থাকলেও পছন্দের ব্যবসায়ীকে বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। ফলে প্রতি বছর অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গচ্চা যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, গ্যাসের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নতুন মহাপরিকল্পনাকে অবাস্তব উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতসহ দেশের অর্থনীতি আরও খাদে পতিত হবে। 

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করবে। তখনকার অর্থনীতির আকার ধরে এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়েছে। আগের মহাপরিকল্পনা অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি, তাই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে– এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মাথপিছু বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়বে। ফলে বাড়তে পারে বিদ্যুৎ ব্যবহার। এ ছাড়া চাহিদার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা থাকতে হয়। তাই এই মাস্টারপ্ল্যান অযৌক্তিক নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button