বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে সংকট কাটছে না
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ডলার সংকট কাটছে না। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে নগদ টাকার স্বল্পতাও। অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার চিঠি দিয়ে, বৈঠক করেও সমস্যার সমাধান মিলছে না। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপে ডলার ছাড় শুরু হলেও তা চাহিদার চেয়ে কম। সংকট এমন পর্যায়ে ঠেকেছে, আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো পণ্য সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে। সংকট কাটাতে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে অনেক সংস্থা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের জ্বালানি আমদানিনির্ভর। ডলার আর টাকার সংকট না কাটলে সামনে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেবে।
ডলার পাচ্ছে না বিপিসি
জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে গত ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯৬ মিলিয়ন ডলার পাবে। এর মধ্যে ইউনিপেক ৫১.৯৪ মিলিয়ন ডলার, পিসিএসজি ১৫.২৮ মিলিয়ন ডলার, ভিটল ৪২.৪ মিলিয়ন ডলার, বিএসপি ১২.৪৭ মিলিয়ন ডলার এবং পিটিএলসিএল ১৯.১৯ মিলিয়ন ডলার পাবে। বিপিসি জানিয়েছে, পাওনাদারদের মধ্যে ইউনিপেক কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন ডলার এবং পিসিএসজিকে ৫ মিলিয়ন ডলার দ্রুত পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে কোম্পানি দুটো পরবর্তী কার্গো সরবরাহ করবে না। পাওনার অধিকাংশই সোনালী ব্যাংকে আটকে আছে। পাশাপাশি জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকও ডলার দিতে পারছে না।
জানতে চাইলে বিপিসির এক মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করে সমকালকে বলেন, তাদের হাতে টাকা আছে, তবে ডলার মিলছে না। যতটুকু ডলার পাওয়া যাচ্ছে, চাহিদার তুলনায় কম। গত এক মাসে ৫৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বিপিসি। তিনি বলেন, ডলার না থাকায় এলসি খুলেও জ্বালানি তেল আমদানি করা যাচ্ছে না।
পিডিবির দেনা
দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। তাই ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও কেন্দ্র ভাড়ার পেছনে কয়েক বছরে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে গচ্চা গেছে। এই বাড়তি খরচের কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়, পাশাপাশি বেড়েছে লোকসানও। বর্তমানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেনা ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর অধিকাংশই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা।
গত অর্থবছরে পিডিবির দেনা ছিল ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থ বিভাগ ১২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ছাড় করে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরের বকেয়া ৩০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেনা হয়েছে ১২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।
গ্যাসেও জমেছে বকেয়া
জানা গেছে, গ্যাস বিক্রি (এলএনজিসহ) বাবদ বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো (আইওসি) পেট্রোবাংলার কাছে প্রায় ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা পাবে। এর মধ্যে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কেনা বাবদ বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। শেভরনসহ দেশে কর্মরত আইওসিগুলো গ্যাস বিক্রি বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে ১ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা পাবে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করে জানান, তারা ডলার সংকট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) ঋণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু সুদ বেশি তাই অর্থ বিভাগ বিষয়টি পেট্রোবাংলার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, বেশি সুদ হলেও তাদের ঋণ প্রয়োজন। কারণ ডলার সংকটের কারণে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও আইওসির বিল পরিশোধ করতে পারছেন না। বর্তমান বকেয়া পরিশোধ ও আগামী ছয় মাসের জন্য এলএনজি আমদানি নিশ্চিত করতেই আইটিএফসি থেকে উচ্চ সুদে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। চাহিদা না থাকায় অলস থেকেও অর্থ পাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এই বাড়তি বোঝা এখন সরকারও টানতে পারছে না। তিনি বলেন, তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানির দিকে বেশি ঝোঁকার কারণ এখানে কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। ব্যয়বহুল এলএনজি এখন বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।