Hot

বিপুচক্রে পাচার কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদ্যুৎ খাতে হরিলুট

  • বিপুর সম্পদের পাহাড় বিভিন্ন দেশে
  • বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠিত টাকায় বহু দেশে গড়েছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ ১১ বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নসরুল হামিদ বিপু ও তাঁর ভাই-বন্ধু মিলে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। পাচারের অর্থ দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন দেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বিপু ও তাঁর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল), মামা কামরুজ্জামান চৌধুরীসহ অন্য আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের দুর্নীতির তথ্য বের হচ্ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে বিপুর অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বারমুডা, মাল্টা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, মোনাকো, সাইপ্রাস ও তুরস্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কম্পানি খুলে ওই কম্পানির মাধ্যমে বিপু হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই কম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে বিপু তাঁর নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন।

পাঁচ বেডরুমের ওই বাসার বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪১৫ মার্কিন ডলার। সেখানে শরীফ হায়দার নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিপুর স্ত্রী সীমা হামিদকে নিয়ে পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ট্রেড করপোরেশনের লাইসেন্স নেন। এই করপোরেশনের আওতায় মোবিল গ্যাস স্টেশনসহ দেড় ডজনের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওই গ্যাস স্টেশনটি কেনা হয় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

আর শরীফ হায়দারের মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেন বিপু।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিপুর স্ত্রী সীমা হামিদের নামে তিনটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। দুবাইয়ের পাম বিচে বিলাসবহুল বাংলোয় থাকেন বিপুর ছেলে জারিফ হামিদ। সেখানে তাঁর একাধিক ব্যবসা রয়েছে। লন্ডনে স্টাটফোর্ডে আছে বিপুর বাড়ি।

তাঁর ব্যবসা রয়েছে ম্যানচেস্টারে। কানাডায় আছে একটি আবাসিক হোটেল এবং একটি পেট্রল পাম্প। সিঙ্গাপুরে স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত বিপুর অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে বিপুর হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। মাল্টায় বিপুর স্ত্রী সীমা হামিদের নামে একটি বার ও ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ায় জারিফ রাবার ফ্যাক্টরির বেশির ভাগ শেয়ার বিপুর ছেলে জারিফের নামে। এই শেয়ারের মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠিত এসব টাকায় বিভিন্ন দেশে রয়েছে বিপুর সম্পদের পাহাড়।

বিপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) পাচার করা অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্য গড়েছেন। সেখানে বিলাসবহুল বাড়ি কেনাসহ অবৈধভাবে নানা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন তিনি। দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে কাজলের বিত্ত-বৈভবের নেপথ্যে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ পাচার।

অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের স্থানীয় সম্পদ আইনি প্রক্রিয়ায় বাজেয়াপ্তের চেষ্টা করা উচিত। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে ভবিষ্যতে পাচারকারীরা আরো উৎসাহিত হবেন। টাকা পাচারের আগে যে প্রশ্রয় পেয়েছিলেন, সেই ধরনের প্রশ্রয় আগামী দিনে আর দেওয়া হবে না—এই ধরনের ভীতি তৈরি করতে হবে। সেটার প্রমাণ হিসেবে কয়েকজন পাচারকারীকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’

সূত্র জানায়, কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ ধাপে টাকা আদায় করত বিপুর ভাই-বন্ধু চক্র। এর মধ্যে ছিল প্ল্যানিং, সাইট ভিজিট, মেশিনপত্র অনুমোদন দেওয়া, নেগোসিয়েশন, প্রকল্পের সাইট সিলেকশন, মাটি ভরাট, জমি ক্রয়, বিদ্যুৎ ক্রয়ের দরদাম ঠিক করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা বা কমিশনিং, মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো, ক্রয় অনুমোদন, বিল অনুমোদন, বিল ছাড় করা অর্থাৎ প্রতিটি খাতে এই চক্রকে টাকা দিতে হতো।

বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন কম্পানির কেনাকাটা এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেনাকাটা সংক্রান্ত লোভনীয় কমিটিতে পছন্দের কর্মকর্তাদের রাখা, পদোন্নতি, পোস্টিং দিয়েও এই চক্র হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল অর্থ। বিভিন্ন কম্পানির পরিচালনা পর্ষদে যাওয়ার জন্যও এই চক্র হাতিয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।

চক্রের সক্রিয় সদস্য ছিলেন বিপুর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সাবেক সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা। এসব অপকর্মে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন বিপুর বন্ধু আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) ও রিয়াদ আলী, ফয়সাল ও ওয়াহিদ সালাম। চক্রের অবৈধ আয়ের হিসাব-নিকাশের দায়িত্বে ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মুজাহিদুল ইসলাম মামুন আর কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী শাহীন চেয়ারম্যান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিপুর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা মিলে অন্তত চারটি কম্পানির মাধ্যমে পাঁচ বছরে বাগিয়েছেন আট হাজার কোটি টাকার কাজ। অভিযোগ আছে, শুধু আইটি খাতে তাঁরা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন ১২টি মেগাপ্রকল্প। জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিপিডিসি ও নেসকো থেকে অ্যাডভান্সড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই) নামের দুটি প্রকল্প তাঁরা বাগিয়ে নেন। এই দুটি প্রকল্পের অর্থমূল্য ছিল দুই হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে একই কম্পানি মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড কাস্টমার পোর্টাল প্রতিষ্ঠার নামে ডিপিডিসির কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় আরো একটি বড় প্রকল্প। ওই প্রকল্পের ব্যয়মূল্য ছিল ৫০০ কোটি টাকা। বিপুর ভাই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলিং প্রকল্পের নামে ডিপিডিসি, নেসকো, বিপিডিবি, ডেসকো, আরইবি থেকে সাতটি মেগাপ্রকল্প নিয়ন্ত্রণে নেন। প্রকল্পগুলোর মোট মূল্য ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে ডেটা সেন্টার স্থাপনের নামে বিদ্যুৎ খাতের ছয় কম্পানি থেকে তাঁরা দুটি বড় টেক কম্পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেন আটটি মেগাপ্রকল্প। বিপুর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর ছোট ভাই একটি কম্পানির মাধ্যমে নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিকিউরিটি নামের আটটি মেগাপ্রকল্প নিয়ন্ত্রণে নেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১ জুন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড—আরইবির কাছ থেকে নেন ৫০ লাখ মিটার স্থাপনের কাজ।

মিটার বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার : বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে চার কোটির বেশি গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আমদানি করতে থাকে। এ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। আর এই বাণিজ্যের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নেয় বিপুর ভাই-বন্ধু চক্র। এই চক্রে বিপুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শামসুল আলামিন (কাজল)। মিটার বাণিজ্যের নামে বিপুল অর্থ পাচারেরও অভিযোগ আছে এই চক্রের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। মিটার সরবরাহ বাড়তে থাকে ২০২০ সালের পর। চীনের তিনটি কম্পানি একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে। মিটার উৎপাদন করে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি সরবরাহের জন্য দুটি নতুন সরকারি কম্পানি তৈরি করা হয় বিপুর নির্দেশে।

ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থপাচার : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা দরপত্রে বিশেষ বিধানের আওতায় প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টই (কেন্দ্র ভাড়া) দেওয়া হয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দেওয়া অর্থের বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এসব কাজে বিপু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা যুক্ত ছিলেন। বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পেমেন্ট দিতেই বিদ্যুৎ খাতে বেড়েছে ভর্তুকি।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনা দরপত্রে পছন্দের লোকদের বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এটা এক ধরনের লুণ্ঠন ছাড়া আর কিছু নয়। এই খাতে কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করেছে তা নিয়ে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রাখেনি। আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto