বিমানের চাকা চুরি করে অন্য এয়ারলাইনসে বিক্রি!

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চুরি যাওয়া ১০ চাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়েছে। এসব চাকা চুরি করে একটি চক্র তা বেসরকারি অন্য এয়ারলাইনসের কাছে বিক্রি করছে বলে দাবি করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল (কেপিআইভুক্ত) এলাকায় চুরির ঘটনায় স্থাপনাটির ‘ভঙ্গুর’ নিরাপত্তাব্যবস্থাটি সামনে এসেছে। এটিও খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এ বি এম রওশন কবীর বলেন, ‘নিলামে ওঠানোর জন্য বিমানের অব্যবহৃত টায়ার রাখা ছিল। সেখান থেকে ১০টি টায়ার বিমানের দুই সদস্য একটি এয়ারলাইনসের কাছে বিক্রি করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এখন পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে জড়িতরা চিহ্নিত হবে।
রবিবার এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। এরই মধ্যে বিমানের জড়িত দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’
বিমান চলাচল বিশ্লেষক ও বিমানের সাবেক বোর্ড সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের মতো কেপিআইভুক্ত এলাকায় ১০টি চাকা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। বিমানের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর সুযোগ নিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
এত চাকা নিতে গেলেও তো ধরা পড়া উচিত ছিল। বিমানবন্দরে যেসব পুরনো উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা আছে, সেখান থেকেও নিয়মিত যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে যারা জড়িত, তারা উৎসাহ পায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।’
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত শনিবার।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের পাশে থাকা ‘অকশন শেডে’ রাখা বিমানের ১০টি ‘আনসার্ভিসেবল টায়ার’ (অকেজো চাকা) খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে গত সোমবার (১৮ আগস্ট) বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মোশারেফ হোসেন। জিডিতে সরাসরি ‘চুরি’র অভিযোগ না এনে তিনি উল্লেখ করেছেন যে চাকাগুলো ‘খুঁজে পাওয়া যায়নি’।
জিডিতে বলা হয়, ‘১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১০টি আনসার্ভিসেবল টায়ার বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের পাশে থাকা অকশন শেডে খুঁজে পাওয়া যায়নি। চাকার সন্ধান না পাওয়ায় বিমানের ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট সুপারভাইজার আরমান হোসেন ও স্টোর হেলপার সামসুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যায়, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলামের কাছে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। আর এটি ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষকে’ না জানিয়ে করা হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উড়োজাহাজের টায়ারের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। তবে চুরির কোনো ঘটনা নয়, মূলত একজন আরেকজনকে চাকাগুলো ব্যবহার করতে দিয়েছে। একটি এয়ারলাইনসের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।’
তবে নষ্ট বা ব্যবহার উপযোগী নয়—এই চাকা কোনো এয়ারলাইনসের নেওয়ার প্রশ্নই আসে না বলে জানিয়েছেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যবহার অনুপযোগী চাকা ইউএস-বাংলার লাগবে কেন? প্রত্যেকটি চাকার একটি লাইফটাইম থেকে। তা শেষ হওয়ার পর সেটা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। এরপর সেটা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিমানের চেয়ে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজের সংখ্যা বেশি। ব্যবহার অনুপযোগী টায়ার আমরা আবর্জনা হিসেবে ট্রাকে ভরে বাইরে পাঠিয়ে দিই।’
বিমানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, একেকটি উড়োজাহাজের চাকার দাম পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এই হিসাবে ১০টি চাকার মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় কোটি টাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, অব্যবহৃত হলেও এত মূল্যবান সম্পদ কিভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেল? সাধারণত ব্যবহৃত বা অকেজো মালপত্র নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়, যার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো রকম নিয়ম-কানুন মানা হয়নি, যা একটি বড় আর্থিক অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়।
চাকা ‘চুরির’ অভিযোগ সামনে আসার পর চার সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান। এই কমিটি শুধু চাকা গায়েব হওয়ার ঘটনাই নয়, গত ১ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব কারিগরি সমস্যার বিস্তারিত পর্যালোচনা করবে।
বিমান চলাচল খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানের একের পর এক এই ঘটনাগুলো দেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসের প্রতি আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। চাকা ‘চুরি’ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।