বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্র: খাতুনগঞ্জে ‘স্লিপ বাণিজ্য’
এলএমজি ব্র্যান্ডের এলাচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০০-৬০০ টাকা
স্লিপ বাণিজ্যের নামে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করছে একটি চক্র। এ চক্রে ক্রেতা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে বিক্রেতাও। গুদামে পণ্য থাক বা না থাক-পণ্যের পরিবর্তে কেবল স্লিপ বা কাগজ বিক্রি করেই বিশাল অঙ্কের টাকা বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে তারা। দেখা যায়, এ চক্রে পড়ে কেউ সর্বস্বান্ত বা দেউলিয়া হচ্ছেন। কেউ বা রাতারাতি উঠছেন ফুলে-ফেঁপে। এটিকে একধরনের ‘গেম’ হিসাবেই নিয়েছে চক্রটি। আর এর বলি হচ্ছেন সাধারণ আমদানিকারক, প্রকৃত ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা। বিভিন্ন সময়ে পণ্যমূল্য অস্থির হওয়ার জন্যও এই স্লিপ বাণিজ্য দায়ী বলে মনে করছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। কখনো তেল, কখনো চিনি, কখনো গম, কখনোবা গরম মসলার বাজারে ভর করে ‘স্লিপ বাণিজ্যের’ ভূত।
দুই সপ্তাহ ধরে খাতুনগঞ্জে গরম মসলা হিসাবে পরিচিত এলাচের বাজার স্লিপ বাণিজ্যের দখলে রয়েছে। এ সময়ে কেজিতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেড়েছে এলাচের দাম। ৩ হাজার ৫০০ টাকার এলাচ (এলএমজি ব্র্যান্ড) স্লিপে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকা। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের এ এলাচ স্লিপে উচ্চদরে বেচাকেনা হওয়ার রহস্য বের করতে পারছেন না তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে বেশ কয়েক ধরনের এলাচ আছে। পণ্যটি যত নতুন, এর দাম তত হওয়ার কথা। পুরোনো হলেই মান নিম্নগামী হয়। বাজারে সবচেয়ে বেশি চলে এমন দুই ক্যাটাগরির এলাচের একটি হচ্ছে জিবিসি (গ্রিন ব্লাস্ট ক্রাউন) ও এলএমজি (লাইট মিডিয়াম গ্রিন)। এর মধ্যে এলএমজি ব্র্যান্ডের এলাচ গুণগতমানে অপেক্ষাকৃত নিম্ন। এটি ২০২২ সালে আমাদনি করা। কিন্তু এরপরও এই এলাচ স্লিপে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকায়। আর গুণগত মানে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের এলাচ জিবিসি, যেটি ২০২৩ সালে আমদানি করা, সেটি ৩ হাজার ৫০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না। অথচ নতুন শস্য হিসাবে এটি বিক্রি ও দাম দুটিই বেশি হওয়ার কথা। এমন কারসাজির জন্য স্লিপ বাণিজ্যের হোতাদের দায়ী করছেন সাধারণ আমদানিকারকরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, গরম মসলা হিসাবে পাঁচটি পণ্য ধরা হয়। এগুলো হলো-এলাচ, জিরা, দারুচিনি, গোলমরিচ ও লবঙ্গ। এলাচ আমদানি হয় গুয়েতেমালা থেকে। জিরা আমদানি হয় ভারত, সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে। দারুচিনি আমদানি হয় ভিয়েতনাম, চায়না থেকে এবং গোলমরিচ আমদানি হয় মাদাগাস্কার থেকে।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বাড়ার আশায় নামমাত্র অ্যাডভান্স (অগ্রিম) দিয়ে পণ্য বুকিং দেন কিছু ব্যবসায়ী। এক বা দুই মাসের সময় দিয়ে অগ্রিমের টাকার বিপরীতে দেওয়া হয় আমদানিকারকের সিলসাপ্পরযুক্ত স্লিপ। আর সেই স্লিপই ঘুরতে থাকে পুরো বাজারে। হাতবদল হতে থাকে প্রতিদিন। স্লিপ হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের দরও চড়তে থাকে।
জানা যায়, বর্তমানে এলাচের বুকিং রেট প্রতি কেজি ১ হাজার ৩২৫ থেকে ১ হাজার ৩৬০ টাকা। মশলায় গড়ে ৬৯ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। আমদানি হওয়ার পর পণ্যটি বাজারে প্রতি কেজি ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু অন্য সব ধরনের এলাচের বিক্রি একপ্রকার বন্ধ থাকলেও স্লিপ বাণিজ্যের চক্করে পড়ে এলএমজি ব্র্যান্ডের এলাচ রোববারও খাতুনগঞ্জে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ভোক্তাকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। দেশে প্রতিবছর ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টন এলাচের চাহিদা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের একাধিক আমদানিকারক বলেন, কিছু ফ্লোটিং ব্যবসায়ী, যাদের স্থায়ী কোনো অফিস নেই খাতুনগঞ্জে, তারাই স্লিপ বাণিজ্য করে। তারা একেক সময় একেক পণ্য টার্গেট করে। চক্রটি বিশ্ববাজারে খোঁজখবর নেয় বাংলাদেশে আমদানি হবে-এমন কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারে। কোন পণ্যটির উৎপাদন ভালো হয়নি রপ্তানিকারক দেশে। এসব খোঁজখবর নিয়েই মূলত টাকার বস্তা নিয়ে তারা বাজারে এসে টার্গেটকৃত পণ্যটি কিনে কখনো মজুত করে ফেলে। কখনো অগ্রিম বুকিংয়ের নামে হাজার হাজার টন পণ্যের স্লিপ কিনে তা হাতবদল করতে থাকে। এক মাস বা দুই মাস আগে অগ্রিম টাকায় বুকিং দিয়ে বাজার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের স্লিপ কিনে নেয়। প্রতিদিন তা হাতবদল করে। এভাবে দেখা যায়, পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। আর তখনই স্লিপের বিপরীতে বুকিং দেওয়া পণ্যটি গুদাম থেকে ডেলিভারি নিয়ে বাজারে ছেড়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটে নেয় চক্রটি। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। আবার দেখা যায়, কোনো কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বুকিং রেট কমে গেলে স্লিপের বিপরীতে বুকিং দেওয়া পণ্য ডেলিভারি নেওয়া হয় না। বুকিং মানি ফেলে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় স্লিপ বাণিজ্যের হোতারা। এতে যে আমদানিকারক স্লিপ বিক্রি করেন, তাকেই বড় ধরনের লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়। গুদামভর্তি পণ্য নিয়ে করতে হয় ‘কান্নাকাটি।’ অনেকে দেউলিয়া হয়ে যান। অন্যদিকে কেউ কেউ পণ্য ছাড়াই কেবল স্লিপ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। এমনও দেখা গেছে, গুদামে নেই অথচ স্লিপে টনকে টন পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ওই পণ্যটির দাম বাড়লে তখন যদি পণ্য দিতে না পারেন, তবে বাজারদর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পণ্যের টাকা দিতে হয় স্লিপের ক্রেতাকে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ সাধারণ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘স্লিপ বাণিজ্য কোনো ব্যবসা হতে পারে না। এই অস্বাভাবিক ট্রেড বা বাণিজ্য খাতুনগঞ্জের বাজারকে সব সময় অস্থির করে রাখে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে এ ধরনের অনেক এলাচ থাকলেও কেবল গুয়েতেমালা থেকে আমদানি করা এলএমজি ব্রান্ডের এলাচ নিয়ে জুয়া চলছে। ভালো মানের এলাচ বিক্রি না হলেও নিম্নমানের এলাচ স্লিপে চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে। গুদামে পণ্য নেই অথচ স্লিপ বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। স্লিপ বাণিজ্যের হোতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে তিনি সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, শুধু এলাচ নয়, তেল, চিনি, গমসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও তাদের দৌরাত্ম্য মাঝেমধ্যে বেড়ে যায়। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের।