International

বিশ্বজুড়ে যখন মূল্যস্ফীতি, চীনে কেন ঘটছে উল্টাটা

চীনে ‘কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স’ ০.৩ শতাংশে নেমে গেছে

বিশ্বের অনেক দেশেই যখন মূল্যস্ফীতি একটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ওই সময় চীনে দেখা যাচ্ছে এক উল্টো অবস্থা। মুদ্রাস্ফীতির হার কমতে কমতে ঋণাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে।

চীনে দুই বছরের মধ্যে প্রথম এমন পরিস্থিতি হয়েছে যখন আগের বছরের তুলনায় কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা মূল্য সূচক ০.৩ শতাংশ কমে গেছে।

দেশটির আমদানি-রফতানির চিত্রও খুব খুব একটা ভালো দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভোক্তার চাহিদা বাড়াতে চীনের সরকার বেশ চাপে পড়বে।

ডিফ্লেশন বা মূল্য-সংকোচন কী?
যখন চাহিদার কমতির কারণে পণ্য বা সেবার দাম আগের চেয়ে পড়ে যায় তখন সেটাকে বলা হয় ডিফ্লেশন বা মূল্য-সংকোচন।

মূল্যস্ফীতি হলে কোনো কিছু কিনতে বেশি দাম দেয়া লাগে, চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের তুলনায় অর্থের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। আর মূল্যসংকোচন হচ্ছে তার উল্টোটা – এতে দ্রব্য বা সেবার দাম কমে যায়, অর্থের মূল্য বাড়ে, অর্থাৎ একই দামে আগের চেয়ে বেশি জিনিসপত্র কেনা যায়।

এর পেছনে অনেক ধরণের কারণ থাকে। যেমন ভোক্তার চাহিদা কমে যাওয়া, কঠোর মুদ্রানীতির ফলে অর্থের যোগান কমে যাওয়া, মানুষের ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ে আগ্রহী হওয়া, উৎপাদন খরচ কমে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া বা অর্থনৈতিক মন্দা – এমন অনেক বিষয়।

কেন চীনে এমন হলো?
কোভিড মহামারির সময়ে এমন পরিস্থিতি অনেক দেশেই হয়েছে। কারণ সেসময় মানুষের হাতে টাকা থাকলেও খরচের সুযোগ কমে গিয়েছিলো।

বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর মানুষ খরচ করতে শুরু করলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষিতে আরও বেড়ে যায় জীবনযাত্রার ব্যয়।

সেখানে চীনের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটার পেছনে দেশটির অর্থনীতিতে মানুষের চাহিদার মাত্রা ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকার দিকে নজর দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চায়না সেন্টারের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট জর্জ ম্যাগনাস।

সোজা ভাষায়- মানুষ সেখানে বেশি খরচ করতে চাচ্ছে না, তাদের চাহিদা কমে গেছে।

ম্যাগনাসের মতে, ‘চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়ায় দামের দিকটাও দুর্বল হয়ে গেছে।’

মহামারীর কঠোর বিধিনিষেধ থেকে বের হয়ে আসার পরও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবের দিকটার কথাও উঠে আসছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে বিভিন্ন উন্নত দেশে মহামারীতে সরকার জনগণকে আর্থিক নানা সুযোগ সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু চীনে মানুষকে নিজের ভরসাতেই চলতে হয়েছে।

দেশটির সরকারের বরাদ্দ সুযোগ-সুবিধা মূলত উৎপাদন খাতের জন্য ছিল। ফলে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পরও অর্থনীতিবিদেরা যেমন আশা করেছিলেন, মানুষ সেভাবে খরচ করেনি।

মজুরি বা পেনশনের দিক দিয়ে মানুষ তেমন উন্নতি দেখছে না, চাকরির বাজারে রয়েছে অনিশ্চয়তা, মানুষের খরচের ব্যাপারে আগ্রহ কমে গেছে। ধীরগতিতে বাড়তে থাকা অর্থনীতিতে মানুষের আস্থা কমে গেছে।

চীনের মূল্য সূচকের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শূকরের মাংসের দাম ৭.২ শতাংশ থেকে একেবারে ২৬ শতাংশ কমে যাওয়া, কারণ একদিকে মানুষ কম খরচ করছিল, সে তুলনায় সরবরাহ অনেক বেশি ছিল।

মানুষের কমতে থাকা চাহিদাকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো। তার মতে, ‘মূল্য-সংকোচন চীনকে সাহায্য করবে না। ঋণের বোঝা আরও ভারী হয়ে উঠবে। এসব কিছুই ভালো খবর নয়।’

হংকং-এর একজন অর্থনীতিবিদ জিয়া চুন রয়টার্সকে বলছেন যে তার ধারণা চীনের এই মূল্য সংকোচন ছয় মাস থেকে এক বছর স্থায়ী হতে পারে।

বিশ্বের জন্য এর অর্থ কী
বিশ্বজুড়ে যেসব পণ্য বিক্রি হয় তার একটা বড় অংশ আসে চীন থেকে।

যদি চীনে মূল্য-সংকোচন দীর্ঘায়িত হয়- তাহলে সেটা অন্যান্য দেশের জন্য সুফল এবং কুফল দু’টিই বয়ে আনতে পারে।

ভালো সংবাদ হচ্ছেট, তখন অন্যান্য দেশ তুলনামূলক কম দামে চীনের পণ্য কিনতে পারবে, যেটা সেসব দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। আর খারাপ দিক হতে পারে, সেসব দেশের উৎপাদকদের এটা হুমকিতে ফেলবে।

বাজারে কম দামে চীনা পণ্য বিক্রি হলে স্থানীয় পণ্য বা ব্যবসায়ে এটা আঘাত করতে পারে, তাতে ব্যবসায় বিনিয়োগ কমবে এবং কর্মসংস্থানের জায়গাও কমে যাবে। সেক্ষেত্রে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে।

এছাড়া চীনের বাজারে চাহিদা কমলে বিশ্বের রপ্তানি খাতেও এর আঘাত এসে পড়বে।

চীনের অর্থনীতির গভীর সঙ্কট
সাময়িকভাবে মূল্য-সংকোচন মানুষের জন্য দাম কমার ইতিবাচক প্রভাব রাখলেও দীর্ঘমেয়াদে বেকারত্বের সমস্যা তৈরি করতে পারে।

মূল্য-সংকোচন হলে ব্যবসা বিনিয়োগে এর প্রভাব পড়ে কারণ এমন অবস্থায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। ঋণদাতারা লাভবান হন, ঋণগ্রহীতা চাপে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্ত হন করদাতা ও কৃষক শ্রেণি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ক্ষতির মুখে পড়ে।

শুধু যে মূল্যসংকোচনই চীনের জন্য সমস্যা তেমনটা নয়।

সরকারি অন্য আরেকটি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় জুলাই মাসে চীনের রফতানি ১৪.৫ শতাংশ কমে গেছে। সেটা এমন উদ্বেগই বাড়িয়ে দেয় যে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর আরও মন্থর হতে পারে।

একই সাথে দেশটি আবাসন খাতেও আরও আগে থেকে সঙ্কটে আছে। বিশেষত দেশটির সবচেয়ে বড় রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার এভারগ্রান্ডের প্রায় পতনের দিকে যেতে নেয়ার পর থেকে।

চীন সরকার বার্তা দিচ্ছে যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে তারা এখন পর্যন্ত কোনো বড় পদক্ষেপ এড়িয়ে চলেছে।

ম্যাগনাস বলছিলেন, ‘সবাই প্রত্যাশা করে সরকার অল্প সময়ে কিছু একটা করবে কারণ সরকার বলে তারা করবে। তারা বলে তারা দেশের চাহিদাকে শক্তিশালী করবে, ভোগ বা ব্যয়কে শক্তিশালী করবে। কিন্তু তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তারা ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে।’

তিনি বলেন, সুদের হার কমানো, আবাসন খাতে নিয়মকানুন শিথিল করা, ঋণ করে অবকাঠামো খাতে আরও বিনিয়োগ, এমন কিছু পদক্ষেপের আশা করে মানুষ।

ম্যাগনাস বলছিলেন, ‘তবে আমরা আসলে যেটা দেখতে চাই সেটা হলো সরকার এমন পদক্ষেপ নেবে যাতে করে মানুষের আয় হয়, পকেটে টাকা আসে, যাতে করে মানুষ বাইরে গিয়ে খরচ করতে পারে। যদিও তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’

সাম্প্রতিক সময়েও নীতিনির্ধারকরা ঘোষণা দিয়েছেন যে গাড়ি বা বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বিক্রি বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া হবে, কিছু শহরে সম্পত্তি-সংক্রান্ত নানা কড়াকড়ি সহজ করা হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে এখানে উদ্যম ফেরাতে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রয়োজন।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য নীতি ও অর্থনীতির অধ্যাপক ঈশ্বর প্রসাদ বলেছেন, বিনিয়োগকারী এবং ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা চীনের পুনরুদ্ধারের মূল বিষয় হবে।

অধ্যাপক প্রসাদ বলেন, ‘আসল সমস্যা হলো সরকার বেসরকারি খাতে আস্থা ফিরে পেতে পারে কিনা, যাতে করে পরিবারগুলো সঞ্চয় করার পরিবর্তে ব্যয় করবে এবং ব্যবসাগুলি বিনিয়োগ শুরু করবে।’

এছাড়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে ট্যাক্স কমিয়ে আনার দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। যদিও তার মতে সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

   

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d