Bangladesh

বিশ্ববাজারে কমলেও প্রভাব পড়ে না দেশে

জ্বালানি তেলের দাম – ডলারের ক্রলিং পেগ পদ্ধতিসহ পরিবহন খরচ দায়ী

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বাংলাদেশে গত মার্চ মাস থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করা হয়। এখন প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার সুফল খুব একটা পায় না ভোক্তারা। এর কারণ হিসেবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা জানান, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি বা হ্রাসের ক্ষেত্রে সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সাদৃশ্য বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম কমার পরও দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য না কমার পেছনে তারা ডলারের ক্রলিং পেগ (নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের বিনিময় হার ওঠানামা) পদ্ধতিকে দায়ী করেছেন। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের পরিবহন খরচসহ অন্যান্য কারণকেও চিহ্নিত করেন তারা। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিপিসির মাধ্যমে শতভাগ তেল আমদানি করে। এ আমদানি যে করা হয় তার ওপর মিনিমাম মার্জিন রেখে কখনো বা জিরো মার্জিনে ধরা তেল বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম, সেই দাম ডলার ফ্রাংচুয়েশনের সঙ্গে তেল আনতে গিয়ে পরিবহর খরচ, ইন্স্যুরেন্স, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স এবং ডিউটি এগুলো পরিশোধ করে যে দাম দাঁড়ায় এর সঙ্গে যারা ডিলার আছেন তাদের একটা মুনাফা আছে। পেট্রল পাম্পগুলোতে বাঘাবাড়ীসহ বিভিন্ন জায়গায় তেল নিয়ে যেতে হয় এর খরচ আছে। এগুলোর একটি ফর্মুলা আছে। এই ফর্মুলা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রেটিং করা। এটি আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুযায়ী করা। এভাবেই দেশে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। অনেকেই মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু দেশের বাজারে এর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, এটি খুবই ন্যায্যতার ভিত্তিতেই হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ডলারের ক্রলিং পেগের কারণে আমাদের তেল আমদানিতে বেশি দাম দিতে হচ্ছে। কারণ, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে ১১৮ টাকায়। কিন্তু আমরা ১২০ টাকার নিচে কোনো ডলার পাচ্ছি না। ডলারের ক্রলিং পেগের ফর্মুলা অনুযায়ী আরেকটু বেশি মূল্য দিয়ে আমাদের তেল কিনতে হচ্ছে। আবার এমনও হয়েছে আমাদের টাকা থাকার পরও ডলার না থাকায় আমাদের লেট পেমেন্ট করতে হয়েছে। বিপিসি কর্তৃপক্ষ বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও তা সমন্বয় করে ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব না পড়ার কারণ হচ্ছে এ সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যমান বদলে যাওয়া। সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন সকালে ডিসেম্বর মাসের জন্য বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩ সেন্ট বেড়ে ৭১ দশমিক ৮৩ ডলারে ওঠে। এ ছাড়া নভেম্বর মাসের চুক্তির জন্য ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১ সেন্ট বেড়ে ৬৮ দশমিক ২৮ ডলারে ওঠে। এর আগে ২০২১ সালের পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে। গত এপ্রিল মাসেও অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ৯০ ডলার। গত ১১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৬৭ দশমিক ৬৮ ডলার। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি তেলের দাম ঘোষণা করে। সেপ্টেম্বর মাসের জন্য প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। আর পেট্রল ও অকটেনের দাম কমেছে ৬ টাকা। দাম কমানোর এ হার খুব সামান্য বলে মন্তব্য করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্রেতারা। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব না পড়ার বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়। তেলের দাম নির্ধারণ একটি ফর্মুলার মাধ্যমে হয়। এজন্য বিশ্ববাজারে যেভাবে কমে একইভাবে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমার কথা।

বিশ্ববাজারে দাম অনেকটা কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব না পড়ার কারণ হিসেবে ডলারের বিনিময় হারকে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। সাধারণত দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান হিসাব করা হয়। আগের মাসের জ্বালানি তেলের গড় দামের ভিত্তিতে এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ৩২ শতাংশ শুল্ক-কর, আছে পরিবহন ভাড়া,  ৬ শতাংশ মুনাফা ধরে বিপিসি।

বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য ধরে শুল্ক হিসাব করা হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বা কমলেও এটি পরিবর্তিত হয় না। ট্যারিফ মূল্য সাধারণত কেনা দামের চেয়ে কম ধরা হয়। এতে শুল্ক খরচ কমে বিপিসির। কিন্তু অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে মূল্য শুল্কায়নে সরকারের দ্বৈত নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকরা। এজন্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়নের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে মূল্য শুল্কায়ন একই পদ্ধতিতে হতে হবে। হয় তা ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে, না হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে। সরকার মূলত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল  কেনে। সরবরাহকারীও নির্দিষ্ট থাকে। যেদিন চুক্তি হয়, তার আগের দিনের গড় দামের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়। এর সঙ্গে তেল পরিবহনের জন্য প্রিমিয়াম যুক্ত হয়। তেলের দাম ওঠানামা করে। ফলে যখন দাম কমে যাচ্ছে তখন এই চুক্তি করা হচ্ছে কি না তার ওপর দাম নির্ভর করে। বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তেল কেনে। এ দুই দেশ থেকে মারাবান ক্রুড ও অ্যারাবিয়ান লাইট কেনা হয়। এই দুটি তেলের দাম ডব্লিউটিআই ও ব্রেন্ট ক্রুডের চেয়ে কিছুটা বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশে তেলের পরিশোধনের সক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন। যদিও চাহিদা অনেক বেশি। আমদানিই করতে হয় বছরে গড়ে ৬০ লাখ টনের মতো। সক্ষমতা কম হওয়ায় বাংলাদেশকে পরিশোধিত তেল বা ডিজেল কিনতে হয়। আর এর দাম বিশ্ববাজারে স্বাভাবিকভাবেই অপরিশোধিত তেলের চেয়ে বেশি। ২০২১ সালের নভেম্বরে দীর্ঘদিন পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ সরকার। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদন্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৪ মার্কিন ডলার। এর মাসতিনেক পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে অপরিশোতি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় সরকার ২০২২ সালে আগস্ট মাসে পণ্যটির দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ায়। তখন বৈশ্বিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৯৪ ডলার। এখন সেই দাম ৭০ ডলারে নেমে এলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। ২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়েছিল (প্রতি লিটারে কমেছিল ৫ টাকা)। এরপর থেকে দীর্ঘদিন প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রল ১২৫ টাকা ও অকটেন ১৩০ টাকা বিক্রি হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button