বিশ্ব নদী দিবস আজ: দেশের ৩৮৩ নদীর অনেকগুলোই সংকটাপন্ন, আন্তঃসীমান্ত ৬৯ নদীর স্বীকৃতি মেলেনি
বিশ্ব নদী দিবস আজ। নদী রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার বিশ্বব্যাপী নদী দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে দিবসটি হুট করেই আসেনি। এর পেছনেও রয়েছে নদীর প্রতি ভালোবাসার গল্প। দিবসটির সূচনা হয়েছিল আশির দশকে, কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যে। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নদীপ্রেমিক এক তরুণশিক্ষক মার্ক অ্যাঞ্জেলো তার কিছু ছাত্রছাত্রী ও বন্ধুদের নিয়ে একটি নদীতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান। নদীটি বৈঠা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনপ্রিয় ছিল। সেই নদীতে ফেলা ময়লাগুলো মার্ক অ্যাঞ্জেলোরা পরিষ্কার করেন। তখনো তারা জানতেন না যে, এটি ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদনদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দূষণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, আবাসনের ফলে ছোট-বড় আরও অনেক নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। নদনদী ও প্রাকৃতিক খাল রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে।
বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিটি, বিভিন্ন পরিবশেবাদী সংগঠন। জনজীবনে নদীর গুরুত্ব বাড়াতে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—‘আমাদের জনজীবনে নৌপথ’। এই দিবসে কালীগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী নিয়ে এই আয়োজন।
বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রথম বার রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের নগরায়ণের ফলে নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে নদী দূষণ করছি ও দখল করছি। এখন যদি এসব বন্ধ করতে না পারি, তবে সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে।
একটা সময় শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী ছিল দুই পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। একসময়ে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি পান করত মানুষ। এ নদীতে মাছ ধরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। তবে সময়ের পরিক্রমায় সব কিছুই পালটে গেছে। নদীর পানি পান তো দূরের কথা, এখন শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে মাছ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দূষণের কবলে পড়ে যেমন জৌলুস হারাচ্ছে ১১০ কিলোমিটারের শীতলক্ষ্যা, তেমনি প্রায় মৃত হয়ে পড়েছে ৪৪ কিলোমিটারের বালু নদীটিও। নদী পাড়ের মানুষ একসময় রান্নাবান্নাসহ ঘরের কাজে এ নদী দুটির পানিই ব্যবহার করত।
নদীসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদনদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দূষণ ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, আবাসন, সেতু, কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে ছোটবড় আরও অনেক নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। নদনদী ও প্রাকৃতিক খাল রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও অন্যান্য সুবিধা না থাকায় সংস্থাটি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তার ফলাফল শূন্যই থেকে যায়। এখন যদি এসব বন্ধ করতে না পারি, তবে সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীকে বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজো শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণ বন্ধ করা যায়নি। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে জেলার শ্রীপুর উপজেলার লবণদহ নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিএ, নদী কমিশন এবং জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভারত থেকে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, রৌমারী ও রাজারহাটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে ১৯টি আন্তঃসীমান্ত নদী। তবে ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর তালিকায় উত্তরাঞ্চলে শুধু ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরামের নাম আছে। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৪ নদী। শুধু কুড়িগ্রাম নয়, সারাদেশে এমন ৬৯টি নদী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) তালিকায় নেই। এসব নদীর স্বীকৃতিও নেই।
নদী, জলাভূমি ও পানিসম্পদবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিভারাইন পিপলের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ গবেষণা এখনও চলছে। সংগঠনটি এখন পর্যন্ত ৬৯টি নদীর খোঁজ পেয়েছে। যেগুলো ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি পাওয়া নদী তালিকার বাইরে।