বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য মেলে না বাজারে: ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা লাভে সেই সিন্ডিকেট
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2023/11/image-737259-1699303650.jpg)
সিন্ডিকেট ভেঙে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে একাধিকবার পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে একবারও সেই দামে পণ্য পাওয়া যায়নি। অসাধুরা সরকারের সিদ্ধান্তকে বরাবরই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।
পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এক প্রকার নির্বিকার। এতে পণ্যের দাম নির্ধারণ করার পরও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অতিমুনাফা করেছে। ফলে ক্রেতাসাধারণ বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে ভোক্তা কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছেন না। উলটো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর মানুষের পকেট মেরে লাভবান হচ্ছে কথিত সেই সিন্ডিকেট।
এদিকে বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। সরবরাহও স্বাভাবিক। এরপরও নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য এক বা একাধিক পণ্য টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। চলতি বছরের জুন থেকে অস্থির আলুর বাজার। আগস্টের শেষে প্রতিকেজি আলু ৪০ টাকা বিক্রি হলেও সেপ্টেম্বর মাসে ৪৫ টাকায় স্থিতিশীল থাকে। ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিকেজি আলুর দাম ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে সরকার।
কিন্তু বাজারে এই দাম কার্যকর হয় না। এরপর অক্টোবর মাসের শেষদিকে প্রতিকেজি ৬০-৬৫ টাকা বিক্রি হয়। কিছু কিছু স্থানে ৭০ টাকাও বিক্রি করতে দেখা গেছে। ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। চার দিন ধরে দেশের বাজারে আমদানি করা আলু বিক্রি হচ্ছে। এতে দাম কিছুটা কমলেও সরকার নির্ধারিত দামে আলু পাওয়া যাচ্ছে না। সোমবার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত দরের চেয়ে বাজারে ক্রেতার ২০-২৪ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। মে মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ টাকা। পরিস্থিতি এমন যে, এই পেঁয়াজ অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ১০০-১১০ টাকা বিক্রি করে। মূল্য কারসাজি রোধে ১৪ সেপ্টেম্বর কিছুটা মূল্য কমিয়ে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সে সময় বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। পরে দেশের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ ও দাম সহনীয় রাখতে রপ্তানিতে প্রতিটন ৮০০ ডলার মূল্য বেঁধে দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তবে আমদানি মূল্য ঘোষণার পরপরই ফের দেশে কারসাজি করে বাড়ানো হয় দাম। সোমবার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা। আর আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। ফলে সরকারের নির্ধারিত দামের তুলনায় ক্রেতার প্রতিকেজি পেঁয়াজ কিনতে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর করছেন না। এমনকি অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে।
মূল্য নির্ধারণ করার পর তা না মেনে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করায় ক্রেতার বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। এতে ক্রেতাদের চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকিতে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের সমন্বিত তদারকির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই অবস্থা থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিপিস ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে হয় ১১ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতি পিস ডিমের দাম ১৬ টাকাও বিক্রি হয়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিপিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তারপরও খুচরা বাজারে প্রতিপিস ১৩-১৪ টাকায় বিক্রি হয়। মূল্য নিয়ন্ত্রণে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই আমদানি করা ডিম দেশেও এসেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতিপিস ডিম কিনতে ক্রেতা ১৩ টাকা খরচ হচ্ছে।
এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খোলা চিনির কেজি ছিল ৯০ টাকা। চলতি বছরের মে মাসে দাম বেড়ে হয় ১৩৫ টাকা। এর এক মাসের মধ্যেই কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে অর্থাৎ জুনে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। যদিও সরকার কেজিপ্রতি চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৩০ টাকা। কিন্তু সেই দামও মানা হচ্ছে না। সোমবারও খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর দিকেই মিলাররা চাল নিয়ে কারসাজি শুরু করে। পরিস্থিতির সুযোগ বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগায় তারা। বাড়াতে থাকে সব ধরনের চালের দাম। মিলারদের কারসাজি রোধে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বৈঠকও করেন। তখন সবচেয়ে ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিলগেটে ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের মধ্যে বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু তখন এই বেঁধে দেওয়া দাম মিল পর্যায়ে মানা হয়নি। ওই সময় মিলগেটে প্রতিবস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
অন্যদিকে ২০২০ সালে সরকার মিল পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন ১৩৫ ও খোলা সয়াবিনের দাম ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তখন বাজারে বোতলজাত সয়াবিন ১৪০-১৪৫ টাকায় ও খোলা সয়াবিন ১২০-১২২ টাকায় বিক্রি হয়।
এছাড়া ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা। ওই দরে বাজারে সয়াবিন পাওয়া যায়নি। পরে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৬৮ টাকা। ওই দামেও তেল মেলেনি। ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে তেলের দাম কমিয়ে ওই বছরের ২০ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে বোতলজাত সয়াবিন প্রতিলিটারের দাম ১৬০ টাকা ও খোলা সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৩৬ টাকা। তবে বাজারে তখন বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫-১৭০ টাকা ও খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৩-১৫৪ টাকায়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা তা দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।