বেপরোয়া সোনা কারবারিরা, যাচ্ছে ডলার আসছে সোনা
প্রতিবছর আকাশপথে উড়ে আসছে টনের পর টন অবৈধ সোনা। সঙ্গে আছে বৈধ পথে আসা আমদানির একটি বড় অংশও। তবে বিপুল পরিমাণ এই সোনা থাকছে না বাংলাদেশে। উড়ে আসা এই সোনার চালান স্থলপথ হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।
ভৌগোলিকভাবে সুবিধাগত অবস্থানের কারণে দিনে দিনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালান চক্রের জন্য খুবই পছন্দ ও নিরাপদ রুট। কিন্তু পাচারের এই জালে জড়িয়ে দেশ হারাচ্ছে বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স। খোদ সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে আকাশপথে আসা অবৈধ সোনার মধ্যে গত ১০ বছরে দুই হাজার ৬৪৯ কেজি সোনা আটক করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
প্রধান তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর থেকে এসব সোনা আটক করে সংস্থাটি। আটক করা সোনার দাম প্রায় এক হাজার ৩৮৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বা ১৬২.৪৯ মিলিয়ন ডলার।
বিপুল অঙ্কের এ সোনা উদ্ধারের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ২৯৫টি ফৌজদারি মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ২৮৮ জন আসামিকে।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি সোনা আটক হয়, যার পরিমাণ ৬২৩.৭০৮ কেজি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবৈধ সোনা আটক হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে, প্রায় ৫৬৫.৭১ কেজি।
এ ছাড়া শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৬৩.৭৯ কেজি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২১.৬৮১ কেজি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬০.৩০ কেজি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬৯.২৫ কেজি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮০.৩৫ কেজি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭৪.৪৯ কেজি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২২৪.২৪৯ কেজি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৬৫.৬৫ কেজি সোনা ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে সোনা পাচারের তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
তথ্য বলছে, চোরাকারবারিরা ঘোষণা না দিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিমানবন্দর থেকে সোনা বের করে নিতে চেয়েছিল।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিমানের সিট ও বিমানযাত্রীর পায়ুপথ বা রেক্টম থেকে বেশির ভাগ সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া গায়ের জামার সুতার সঙ্গে মিশিয়ে, বিভিন্ন ইলেকট্রিক ডিভাইসের ভেতরের যন্ত্রাংশ ও ব্যাটারি, টয়লেট, লাগেজ প্রভৃতি থেকেও সোনা উদ্ধার করা হয়।
যদিও বিশেজ্ঞরা বলছেন, আটকের এ পরিসংখ্যান অবৈধ চোরাচালানির বাস্তব চিত্র নয়। তাঁদের মতে, বিমানবন্দরগুলোতে যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ে, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি সোনা বেরিয়ে যায় নির্বিঘ্নে। সবশেষে শুল্ক ফাঁকির এসব সোনা চলে যায় সোজা ভারতে। এ কারণে সরকার প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
এদিকে সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থান দিয়ে ভারতে পাচারের সময় গত ৯ বছরে ৭৭৫.৯১৯ কেজি সোনা আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় ভারতে পাচারের অভিযোগে অবৈধ সোনাসহ ২৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সংস্থাটি চোরাচালানের ২৮৯টি মামলাও করে।
বিজিবির তথ্যে দেখা যায়, গত ৯ বছরে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের সময় সবচেয়ে বেশি সোনা আটক হয় ২০১৮ সালে, প্রায় ১৯৫.৭৮৯ কেজি। ২০২২ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৪.৯৯৩ কেজি সোনা আটক হয়। ২০১৪ সালে ৪২ কেজি, ২০১৫ সালে প্রায় ২৮ কেজি, ২০১৬ সালে ৩৯.৭৯৬ কেজি, ২০১৭ সালে ৮২.৩৯৬ কেজি, ২০১৯ সালে ৫৪.২৩৪ কেজি, ২০২০ সালে ৮৭.৯২৯ কেজি এবং ২০২১ সালে ৫০.৭৯৭ কেজি সোনা আটক করে বিজিবি।
বৈধ পথে আমদানি বাড়লেও পাচার হচ্ছে ভারতে
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রশাসনের কিছুটা কড়াকড়ির কারণে বৈধ পথে সোনা আমদানি বেড়েছে। তবে এগুলোর অধিকাংশই দেশে থাকছে না, চলে যাচ্ছে ভারতে। ভারতে সোনা আমদানিতে শুল্ক তুলনামূলক বেশি হওয়ায় একটি বড় চক্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে পাচারের রুট হিসেবে কাজে লাগিয়ে আসছিল। জানা গেছে, বর্তমানে ভারতে ভরিপ্রতি প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্কসহ বিভিন্ন করভার বাবদ রাজ্যভেদে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হয়। তাদের বিমানবন্দরগুলোতেও শুল্ক-কর ফাঁকি ধরতে কড়াকড়িও বেশি।
ঢাকা কাস্টমস হাউস জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত (১১ মাসে) ঘোষণা দিয়ে ৩২ হাজার ৯৩২ কেজি (৮২৩ মণ ১২ কেজি) সোনা আমদানি করা হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে আমদানি হয় ৭৫ মণ। এই ১১ মাসে আমদানীকৃত সোনার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮০৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এখান থেকে সরকার আমদানি শুল্ক বাবদ প্রায় ৫৬৭ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে বৈধভাবে আমদানি করা হয় ৭০৮ মণ, প্রতি মাসে গড়ে ৫৯ মণ। ওই বছরে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৪৮৯ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সূত্রে জানা গেছে, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে শুল্ক পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনার বার এসেছে ৬৩ হাজার ২৫০টি। এগুলোর ওজন সাত হাজার ৪০০ কেজি। সরকার এখান থেকে রাজস্ব পেয়েছিল প্রায় ১২৭ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে বৈধভাবে সোনার বার এসেছে ৮৩ হাজার ৭৬০টি। এগুলোর ওজন প্রায় ৯ হাজার ৮০০ কেজি। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১৬৮ কোটি টাকা।
জানা যায়, ভারতে সোনা পাচারের সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়েছিল ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট। ওই দিন যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলার শিকারপুর সীমান্ত থেকে ৭৩ কেজি বা ৬২৪টি সোনার বার আটক করে বিজিবি। জব্দ করা সোনার আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ওই ঘটনায় শার্শা উপজেলার শিকারপুর গ্রামের তোজাম্মেল হোসেনের ছেলে মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছিল বিজিবি।
এ ছাড়া ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর বেনাপোল আমড়াখালি বিজিবি চেকপোস্ট থেকে ১৬ কেজি ৫১২ গ্রাম ওজনের ১১২ পিস সোনার বারসহ দুজনকে আটক করে বিজিবি। আটক দুজন হলেন কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার মনু মিয়ার ছেলে ওমর ফারুক (২৭) ও চাঁদপুর জেলার মতলবের উত্তর থানার কালিপুর বাজার এলাকার বারেক সরকারের ছেলে ফরহাদ সরকার (৩২)।
গত বছরের ১৮ অক্টোবর যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছা উপজেলার কাশিপুরে ব্যাঙদা সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতে পাচারের সময় সাড়ে ১২ কেজি ওজনের ১০৬টি সোনার বার আটক করে বিজিবি, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২২ সালের ২০ মে যশোরের কাবিলপুর শ্মশানঘাট এলাকা থেকে ভারতে পাচারের সময় ১৪ কেজি ৪৫০ গ্রাম বা ১২৪ পিস সোনার বার আটক করে বিজিবি। জব্দ করা সোনার বাজারমূল্য ১০ কোটি সাড়ে ১১ লাখ টাকা।
বিজিবির পাশাপাশি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীও (বিএসএফ) ২০২২ সালে উত্তর ২৪ পরগনার গুনারমাঠ গ্রামের কাছে ইছামতী নদীর ধারে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৪১.৪৯ কেজি সোনা আটক করে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এ সোনার বাজারমূল্য ২১ কোটি রুপির বেশি বলে দাবি করেছিল বিএসএফ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
সোনা পাচারের কারণে কয়েকটি দেশের রেমিট্যান্সে টান
এদিকে সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের সংকট ও দাম বৃদ্ধির সৃষ্ট উদ্ভূত সমস্যার জন্য সোনা চোরাচালানকে দায়ী করা হয়। এতে বলা হয়, সোনা আনার উৎস দেশগুলো থেকে বেশি কমছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ। এর মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে সর্বোচ্চ ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে রেমিট্যান্স।
প্রতিবেদনে সোনা আমদানিতে ব্যাগেজ রুলস সংশোধন করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রদত্ত সুযোগ ব্যবহার করে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্সের বদলে সোনা নিয়ে আসা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে সোনা আনতে প্রবাসে কর্মরত একটি সংঘবদ্ধ চক্র বা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। দেশে ফেরত আসার সময় প্রবাসী শ্রমিকরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে বহন করে। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে নিয়ে ওই দেশেই সোনার দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় সোনা নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে। এগুলো ভারতে পাচার হয় বলে এই প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে।
ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, একজন যাত্রী বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় ১০০ গ্রাম (সাড়ে আট ভরি) ওজনের স্বর্ণালংকার আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক-কর দিতে হয় না। এ ছাড়া একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম (২০ ভরি) ওজনের সোনার বার আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভরিপ্রতি দুই হাজার টাকা করে শুল্ক দিতে হয়।
এদিকে খোদ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আবু সালেহ মোস্তফা কামাল এ কাজে বিমানের কর্মীরা জড়িত ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, সোনা চোরাচালানে যুক্ত থাকায় গত বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১৩ জন কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০২টি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শাস্তি হয়েছে ১৭৮টিতে। এসব মামলায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ৫২ জনকে। তাঁদের ১৩ জন সোনা চোরাচালানের বিভিন্ন মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া তিনজনকে অপসারণ করা হয়েছে। পদাবনতি দেওয়া হয়েছে দুজনের। ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রাখা হয়েছে ১৫ জনের। অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৯ জনকে। ২৫ জনকে তিরস্কার করা হয়েছে। ৩৪ জনকে ‘কঠোরভাবে’ সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
সোনা জব্দ ও সোনা আমদানির বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার এ কে এম নূরুল হুদা আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা সময় ছিল, দেশে সোনা আনার কোনো অনুমতি ছিল না। তাই চাহিদা মেটাতে নানাভাবে সোনা আনা হতো। যখন থেকে বৈধভাবে সোনা আমদানি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তখন থেকে কিছু অসাধু ব্যক্তি ছাড়া সচেতনরা ট্যাক্স দিয়েই সোনা আনছেন। এ জন্য মনে হচ্ছে সোনা আমদানি বাড়ছে।’ চোরাচালানি সোনা আটক কেন কমছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চোরাচালান কিছুটা কমাতে জব্দের সংখ্যাটাও কমেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সোনার শিল্প যাত্রা শুরু করলে ব্যক্তি পর্যায়ে আমদানি ও চোরাচালান দুটোই কমে আসবে।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফখরুল আলম কালেন কণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা চোরাচালানি ঠেকাতে শুল্ক গোয়েন্দা সব সময় তৎপর আছে। আমরা বিজিবি, আর্ম ফোর্সেস, সোর্সসহ সব স্টেকহোল্ডারকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করছি। এ জন্য সাম্প্রতিক সময়ে এয়াপোর্টসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সোনা বেশি ধরা পড়ছে।’