Bangladesh

বেসরকারি খাতের গলা টিপে ঋণ নিয়ে চলবে দেশ?

গত প্রায় ১০ মাসে সরকারের অর্থনৈতিক প্রবণতা শুধু ঋণমুখী। যেখান থেকে পারছে সরকার ঋণ করার চেষ্টা করছে। আর এই ঋণ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্বার্থের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে দেশ।

ঋণ করে ঘি খাও- চার্বাকের এই দর্শন আধুনিক অর্থনীতিতে অচল। ঋণের পরিণাম যে কত ভয়াবহ হয় তা সবাই জানে। ঋণ করে ঘি খাওয়ার দিন এখন আর নেই। বরং ঋণে জর্জরিত একজন ব্যক্তি বা একটি রাষ্ট্র সর্বস্ব হারায়। তার উন্নয়ন অগ্রগতির সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ কি সেই পথেই যাচ্ছে?

আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। মাত্র ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করে এই বাজেট হচ্ছে পুরোপুরি ঋণনির্ভর। বাজেটের আকারও কমানো হয়েছে। আসন্ন বাজেটে বেসরকারি খাতকে উজ্জীবিত করার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ঋণের লাগাম টেনে ধরার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু গত প্রায় ১০ মাসের সরকারের অর্থনৈতিক প্রবণতা শুধু ঋণমুখী। যেখান থেকে পারছে সরকার ঋণ করার চেষ্টা করছে। আর এই ঋণ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্বার্থের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে দেশ।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ ১০৩ বিলিয়ন ডলার। জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা জনপ্রতি মানুষের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭০০ ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ টাকার কাছাকাছি ঋণ প্রতিটি মানুষের। আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে, তার কাঁধে ১ লাখ টাকার ঋণের বোঝা আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশের জিডিপির ৪৫ শতাংশই এখন ঋণনির্ভর।

অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন যে, একটি দেশের জিডিপির যখন ৪০ শতাংশের বেশি ঋণনির্ভর হয়, তখন সেটি অর্থনীতির জন্য খারাপ। ঋণ করে সরকারকে চলতে হচ্ছে, দায়দেনা মেটাতে হচ্ছে। বাজেট প্রণয়নের জন্য তীব্র অর্থ সংকটে থাকা সরকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা করতে গিয়ে বেশ কিছু শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। এটিই হলো ঋণ গ্রহণের বিপদ। যখন আপনি ঋণ গ্রহণ করবেন তখন ঋণদাতার শর্তগুলো আপনাকে মানতেই হবে। আর এই কারণেই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে দেশের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করা জরুরি। আর সেটা করার একমাত্র উপায় হলো বেসরকারি খাতকে বিকশিত করা।

কিন্তু এই সরকার গত ১০ মাসে বাংলাদেশের উৎপাদন বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতকে চাঙা করা ইত্যাদির দিকে মনোযোগী না হয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য চেষ্টা করছেন। ঋণ দিয়ে দেশ চালানো এক আত্মঘাতী নীতি গ্রহণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই নীতি গ্রহণ করতে গিয়ে অর্থনীতি আরও পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি গত ১০ মাসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে খুব একটা আশার আলো দেখা যায়নি, বরং রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কার শঙ্কা তৈরি করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, সেটি যদি কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়বে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে ভারত বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেগুলো সরাসরি আমাদের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যেমন ভারতের ওপর দিয়ে গার্মেন্টস রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেভেন সিস্টারসে ভারত বাংলাদেশের পণ্য আমদানি বন্ধ করেছে। সামনের দিনগুলোতে যদি আমরা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না করতে পারি তাহলে এই সমস্যাগুলো বাড়তে থাকবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত। মূলত আমাদের বেসরকারি খাতের ওপর ভর করেই অর্থনীতি সচল থাকে, অর্থনীতির এগিয়ে যায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বেসরকারি খাতকে বুলডোজার দিয়ে পিষ্ট করার প্রবণতা মেতে উঠেছে কেউ কেউ। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে বেসরকারি খাত। হত্যা মামলা, হয়রানি, শিল্প-কারখানা ধ্বংস করা, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বেসরকারি খাতের বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ যারা অর্থনীতির সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত, তারা এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে।

৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৭৭৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা হয়েছে। সেসব আসামির মধ্যে ৩৫ হাজার ৭৭৩ জন হলেন ব্যবসায়ী। অর্থাৎ বাংলাদেশে এমন এক ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার বিরুদ্ধে কোনো হত্যা মামলা, হত্যাচেষ্টা মামলা বা অন্য কোনো মামলা নেই। শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে এক অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর থেকে নতুন কোনো অভ্যন্তরীণ শিল্প উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। যারা বিভিন্ন শিল্প উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তারাও এখন অপেক্ষা করছেন, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

লক্ষণীয় ব্যাপার এই সময় বিএফআইইউর হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ৬ হাজার ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজারই হলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের যদি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়, তাহলে তারা ব্যবসা করবেন কীভাবে? ব্যবসায়ীরা আক্রান্ত হলে শুধু তারা আক্রান্ত হন না। তাদের সঙ্গে কোটি কোটি শ্রমিক কর্মচারী আক্রান্ত হন। ৫ আগস্টের পর থেকে গত ১০ মাসে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। ছোট, বড়, মাঝারি এসব প্রতিষ্ঠানে কয়েক লাখ কর্মচারী কাজ করতেন। তারা এখন কর্মহীন। তাদের এই কর্মহীনতার মাশুল দিতে হচ্ছে অর্থনীতিতে। বেসরকারি খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার এবং অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতকে আরও বেশি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার কোনো উদ্যোগ গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার গ্রহণ করেনি। বাজেটেও এই আতঙ্কের অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো রূপরেখা নেই।

বেসরকারি খাতকে শত্রু বানানো হচ্ছে। বেসরকারি খাতের মধ্যে কারা ফ্যাসিস্টের দালাল, কারা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ইত্যাদি খোঁজা হচ্ছে। সরকারের যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন তারা খুব ভালোমতোই জানেন, যারা ব্যবসা করেন তাদের সবসময় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে হয়। সরকারের ঘনিষ্ঠ না থাকলে এদেশে কোনো কিছুই করা যায় না। বিশেষ করে গত ১৫ বছর ব্যবসায়ীরা কী পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন তা সবাই জানেন। এ দেশে মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের না ধরলে একটা গ্যাসের লাইন পাওয়া যায় না। একটা ট্রেড লাইসেন্স করতেও তদবির লাগে। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে যদি তারা সম্পর্ক রাখেন তাহলে কি তারা ফ্যাসিস্ট দালাল হবে? একজন ব্যবসায়ী তার নিজের স্বার্থে কিছু করেন না। তিনি কাজ করেন তার কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য। তিনি কাজ করেন সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য।

বিশ্বের যে দেশগুলো উন্নত হয়েছে, তারা বেসরকারি খাতকে আস্থায় নিয়ে বেসরকারি খাতের সঙ্গে একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করছি। এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে এটা স্বাভাবিক। সরকার বেসরকারি খাতকে রীতিমতো পঙ্গু করে ঋণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। আইএমএফ তো আছেই, বিশ্বব্যাংক, এডিপি, চীন, জাপানের কাছে টাকার জন্য হাত পাতছে সরকার। ঋণ পেতে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে টাকা কোনো সমস্যা হবে না। ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সরাসরি যেন দ্রুতগতিতে অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার এই আহ্বানেও খুব একটা সাড়া দেওয়া হয়নি। বরং আইএমএফের ঋণ আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কিস্তির টাকা সময়মতো পাইনি। এরপর অর্থ উপদেষ্টা নিজেই ছুটে যান আইএমএফের কাছে। আইএমএফের শর্ত মানতে তিনি বাধ্য হন। এই শর্তের মধ্যে একটি অন্যতম শর্ত ছিল ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। এই সিদ্ধান্তটি আত্মঘাতী। এমনি বেসরকারি খাতের বারোটা বাজার অবস্থা। তার মধ্যে ডলার ছেড়ে দেওয়ার ফলে এটার প্রভাব আস্তে আস্তে বাজারে পড়তে শুরু করেছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী এনবিআরকে বিলুপ্ত করে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সেটি নিয়েও এখন চলছে উত্তেজনা। এক ধরনের টানাপোড়েনে সরকার এনবিআরের দাবির মুখে সেখান থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছে। কিন্তু আইএমএফের টাকা পেতে গেলে এটা সরকারকে করতে হবে। আমরা যদি বিদেশি ঋণের জন্য ভিক্ষায় নামি তাহলে হয়তো টাকা পাব ঠিকই, কিন্তু আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারব না। জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন পূরণ হবে না। কারণ তারা যে সব শর্ত দেবে, সেই শর্তগুলো হবে অধিকাংশ গণবিরোধী এবং জনগণের ওপর সেগুলো নানা রকম চাপ সৃষ্টি করবে। নতুন নতুন করের বোঝায় পিষ্ট করবে জনগণকে।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বাংলাদেশের বেসরকারি খাতকে সাহস দেওয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো। অবিলম্বে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় হয়রানি বন্ধ করা উচিত। হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহার করতে হবে অনতিবিলম্বে। ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, দুদকে ডেকে মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করতে হবে দেশের স্বার্থে। কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অর্থনীতিকে ধ্বংস করা উচিত হবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor