বেসরকারি খাত ঘিরে অনিশ্চয়তা: ডলার সংকট ও সুদের চাপে উদ্যোক্তারা, আমদানি ও এলসি দুটোই হ্রাস পেয়েছে * অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রয়ক্ষমতা কমায় বিক্রিও কমে গেছে
বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি খাতে বেশ কঠিনভাবেই পড়তে শুরু করেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ডলার সংকটে আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানির আদেশ কমায় এ শিল্পের কাঁচামালের আমদানি ও এলসি দুটোই হ্রাস পেয়েছে। নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে। এখন ঋণে সুদের হার বাড়তে শুরু করেছে। আমদানি পণ্য, ডলার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রয়ক্ষমতা কমায় বিক্রিও কমে গেছে। ফলে শিল্প খাতের উৎপাদনও আগের মতো নেই। এসব মিলে সার্বিকভাবে বেসরকারি খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কেননা কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে পুরো অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার সংকট, এর দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন, বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ করলেই ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংকে ডলার মিলছে না। দেড় বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। এ অবস্থা আরও চলতে থাকলে বেসরকারি খাত বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে।
সূত্র জানায়, বেসরকারি খাতে প্রধান সংকটের মধ্যে আছে ডলার। ডলার না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ডলারের দামও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানি খরচও বাড়ছে। দেড় বছর আগে প্রতি ডলার ছিল ৮৪ টাকা। এখন তা বেড়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। কিন্তু এ দামেও ডলার মিলছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে আমদানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। সংকট দীর্ঘায়িত হলে আমদানিনির্ভর ব্যবসায় সমস্যা আরও বাড়বে। ভোগ্যপণ্যের আমদানিনির্ভর ব্যবসার যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল। তা এখন ক্ষয় হতে শুরু করেছে। গত জুলাই-আগস্টে ভোগ্যপণ্যের এলসি কমেছে ৪০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১ শতাংশ। এলসি কমায় আগামীতে এ খাতের পণ্য আমদানি কমবে।
ইউরোপ ও আমেরিকার মন্দার কারণে দেশে রপ্তানির আদেশ কমছে। ফলে রপ্তানি আয়ও কমছে। গত জুনে রপ্তানি আয় ৫০৩ কোটি ডলার হয়েছিল। এরপর থেকে তা কমছে। জুলাইয়ে ৪৫৯ কোটি ডলার, আগস্টে ৪৭৮ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ৪৩১ কোটি ডলার আয় হয়েছে। অর্থাৎ জুনের পর রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। এদিকে গত অর্থবছরেও ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই আগস্টে ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমেছে সাড়ে ১৭ শতাংশ ও এর আওতায় আমদানি কমেছে ২৮ শতাংশ। ফলে আগামীতে রপ্তানি আয় আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮৬ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশই রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা ইস্যুতে সমস্যার সৃষ্টি হওয়ায় রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলো এখনো মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে রপ্তানি খাত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন উদ্যোক্তারা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে রপ্তানি থেকে। এ খাতের আয় কমে গেলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংকট আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। দুটি অঞ্চলেই এখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। আমেরিকা ঘুরে দাঁড়ালেও সেখানে অন্য সমস্যা শুরু হয়েছে। আগে থেকে রপ্তানির আদেশ কমায় এ খাতের কাঁচামাল আমদানি কমছে। এর প্রভাবে রপ্তানিও কমছে। এ খাত নিয়ে এখন ভাবা উচিত।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স। মোট বৈদেশিক মুদ্রার ২৮ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। এ খাতে গত জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ২২০ কোটি ডলার। এরপর থেকে কমছে। জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি, আগস্টে ১৬০ কোটি, সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে ১৩৪ কোটি ডলার এসেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমায় বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছেন না। ফলে তারা পণ্য আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। এতে আমদানিনির্ভর শিল্পসহ অন্যান্য প্রায় সব শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত মে মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৬৪৬ কোটি ডলার, জুনে আমদানি ব্যয় কমে হয়েছিল ৫১০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা বেড়ে ৫৩৪ কোটি ডলার হয়েছে। আগস্টে তা আরও বেড়ে ৬৪৫ কোটি ডলারে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় আবার আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিমাণে পণ্য আসছে কম। ফলে শিল্প খাত চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামালের জোগান পাচ্ছে না। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বসিয়ে রাখছে। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে শিল্পের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা তাদের নেতিবাচক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের জুলাইয়ে আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছিল ৩৬ শতাংশ। বৃদ্ধির পর হঠাৎ কমে যাওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমায় ছোট উদ্যোক্তারা সংকটে পড়ে অনেকে শিল্প বন্ধ করে দিয়েছেন।
চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ২০ শতাংশ। আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। ফলে যারা মাঝারি কাঁচামাল এনে দেশে পণ্য উৎপাদন করেন তারা এখন সংকটে পড়েছেন।
শিল্পের যন্ত্রপাতি এলে দেশে নতুন শিল্প গড়ে ওঠে। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। এতে নতুন শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়া থমকে গেছে। এখন জরুরি প্রয়োজনে চালু শিল্পের কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি করছেন উদ্যোক্তারা। গত জুলাই-আগস্টে শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে ২২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৫ শতাংশ। এছাড়া বিবিধ শিল্পের এলসি ১০ শতাংশ ও আমদানি ৩৩ শতাংশ কমেছে।
উদ্যোক্তারা জানান, আগে খাদ্যসহ জরুরি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকে ডলার না পেলে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হতো। এখন সেটি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আগে সরবরাহ ঋণের মাধ্যমে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়েছিল সেগুলোর দেনা এখন শোধ করা যাচ্ছে না। এতে উদ্যোক্তাদের দুর্নাম হচ্ছে বিদেশিদের কাছে। ব্যাংকও দুর্নামের ভাগীদার হচ্ছে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এখন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমদানিকারকদের সুদসহ বাড়তি ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৬০৮ কোটি ডলারে উঠেছিল। ওই সময়ে নিট রিজার্ভ ছিল ৪০৬৮ কোটি ডলার। গত ৫ অক্টোবর নিট রিজার্ভ কমে ২১০৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৮০০ কোটি ডলারের কম। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ধরে রাখতে ডলার বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ডলার পাচ্ছেন না।
দেশে ও বৈশ্বিকভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও কমছে। গত বছরের জুলাইয়ে এ খাতে ঋণ বেড়েছিল ১৪ শতাংশ। গত জুলাইয়ে বেড়েছে ১০ শতাংশের কম। অর্থাৎ গত বছরের জুলাইয়ে ঋণ বেড়েছিল ১৩৩১ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে ঋণ তো বাড়েইনি। বরং আগের চেয়ে স্থিতি কমেছে ৮৮০৯ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে এভাবে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়াকে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ হিসাবে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, সুদের হার বাড়তে থাকা ও ডলার সংকটের কারণে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এ কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। এছাড়া তারল্য সংকট থাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক ঋণ নিতে পারছে না। এদিকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণেও ঋণপ্রবাহ কমানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার চেয়ে এ খাতে ঋণপ্রবাহ বেশ কম। গত অর্থবছরে শিল্প উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। আগে এটি ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হতো। কাঁচামাল সংকট ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমায় পণ্যের বিক্রি কমেছে। যে কারণে উৎপাদনও কমেছে।
এদিকে কৃষিঋণ বাড়লেও গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। ফলে গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পগুলো এখন ঋণ সংকটে পড়েছে।
অব্যাহত মন্দার কারণে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণও কমে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মেয়াদি ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিতরণ করা হয় ৬৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিতরণ করা হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকা। তবে মূল্যস্ফীতির হার ও ডলারের দাম বৃদ্ধিজনিত খরচ বাদ দিলে এ খাতে ঋণ বিতরণের হার আরও কম। এদিকে ঋণের সুদের হারও বাড়ছে। আগে যেখানে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যেত। এখন দিতে হবে ১১ থেকে ১৩ শতাংশ। ডলারের দাম যোগ করলে সুদ হার আরও বাড়বে।