বৈরী সময়ে সংকুচিত বাজেট
রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রভাবে চলছে বৈশ্বিক সংকট। যার প্রভাবমুক্ত নয় বাংলাদেশের অর্থনীতিও। টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে প্রায় প্রতিদিনই। আসছে বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। কেননা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে আগামী বছর থেকে। এ ছাড়া আসছে বছর থেকে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারকে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। যা বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এদিকে অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে এবং অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থকে অর্থনীতির মূলস্রোতে আনতে আসছে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আরও বাড়ানো হতে পারে। এতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটবে বলে মনে করে সরকার।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর ডলার সংকট তো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েও সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজস্ব আদায় ও সরকারের চলতি হিসাবেও দেখা দিয়েছে ঘাটতি। এমন এক বৈরী সময়ে নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য সম্পদের সীমাবদ্ধতা আর মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এবারের বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার অংশ হিসেবেই সংকোচনমুখী বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থবিভাগের সূত্রগুলো বলছে, এবারের বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ বছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে এ বছর বাজেটের আকার বাড়ানো হতে পারে ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। যা আগের বছর বাড়ানো হয়েছিল প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। আসছে বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৫০ থেকে ৫ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হতে পারে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা চলতি বছর ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয়েছে।
আগামী বছর মূল্যস্ফীতির চাপকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে নতুন বাজেটে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপ প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি রয়েছে। অর্থবিভাগের সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর যে হারে বাজেটের আকার বাড়ানো হয় এ বছর তা হচ্ছে না। প্রতি বছর সাধারণত ১২-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় বার্ষিক বাজেট। এবার সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। এটাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ ও সংকোচনমূলক বাজেট বলছে সরকার। যা মূলত মূল্যস্ফীতির চাপকে কমিয়ে আনতে আইএমএফের পরামর্শে করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে এবার কমানো হচ্ছে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও। অর্থনীতিতে ভারসাম্য আনতে বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়ে সরকার গঠন করলেও আন্তর্জাতিক নানা চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। তৈরি পোশাক খাতের ওপর আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবিধ নিষেধ এলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ধাক্কা খেতে পারে বাংলাদেশ। এমনিতেই উচ্চ বৈদেশিক ঋণ, ডলার সংকট, ব্যালান্স অব পেমেন্টে নেতিবাচকতা, রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাজার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতিহীনতায় দেশের অর্থনীতি থমকে আছে।
ফলে নতুন মেয়াদের প্রথম বাজেটটি হবে চলমান বৈরী সময়ের ধাক্কা সামলানোর বাজেট বলে মনে করেন অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটকে আমলে নিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাসীপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এবারের বাজেটটা সরকারের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছে যে বাজেটে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটবে। এখন বাস্তবে তা ঘটে কি না-সেটাই দেখার বিষয়। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হচ্ছে। বাজেটে তার কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন। গত ১৩ মের বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয় এবং আলোচনা শেষে অর্থবিভাগ উপস্থাপিত বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত এ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে ৫ জুন থেকে বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।