Trending

ব্যবসায় বাধা সরকারি কর্তাদের ঘুষ

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুরনো বাধাগুলোই নতুন করে সামনে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সরকারি আমলারা, যাদের ঘুষ, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের আইনই দেশে এসব অপরাধ বাড়িয়ে তুলেছে।

গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) ২০২৪ সালের বৈদেশিক বাণিজ্যে বাধাবিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

আমলাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর অভিযোগের বিষয়টি এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে সরকারি এই আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

ইউএসটিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতি বাংলাদেশে একটি বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। দুর্নীতি দমন আইন পর্যাপ্তভাবে প্রয়োগ করা হয় না।

আমলাদের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বাধা আছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য অনেক প্রস্তাব এসেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনে যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করার আগে দুদককে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদকের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে এ আইনে। যদিও দুদক ক্রমবর্ধমানভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের (প্রধানত নিম্নস্তরের কর্মকর্তা এবং কিছু ক্ষেত্রে উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের) বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করছে, সেখানে মামলার একটি বড় স্তূপ পড়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অবাধ ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয়, বিভিন্ন সুবিধা প্রদান ও ‘উপহারের’ বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষ এবং চাঁদাবাজি বাংলাদেশের ব্যবসার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সরকারি ক্রয়বিধিগুলোতে দুর্নীতিবিরোধী আইনগুলোকেও নিষ্ক্রিয় করে রাখার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার কারণে লাইসেন্স ও নিলামের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ বিলম্বের অভিযোগ করেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, দ-বিধি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনগুলো দুর্নীতির চেষ্টা, চাঁদাবাজি, সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় ঘুষ, বিদেশি সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ, অর্থ পাচার এবং সরকারি সম্পদের ব্যবহারে অপরাধ না কমিয়ে বরং বাড়াচ্ছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় তথ্য ব্যবহারও একটি বড় সমস্যা মনে করে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বার্ষিক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। বিদেশে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাবিষয়ক জাতীয় বাণিজ্য মূল্যায়ন প্রতিবেদনটিতে বিশ্বের ৬০টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো উঠে এসেছে।

ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী ২৯ মার্চ মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী ক্যাথরিন টাই ৩৯৪ পৃষ্ঠার বার্ষিক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটি পরে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে সরকারি কেনাকাটার প্রসঙ্গটি এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি কেনাকাটা সাধারণত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬-এর আওতায় দরপত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের নীতি অনুসরণ করলেও দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণভাবেই রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে ইলেকট্রনিক সরকারি ক্রয় পোর্টাল চালু করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অংশীজনরা পুরনো প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি পছন্দের দরদাতার স্বার্থে পক্ষপাতমূলক শর্ত জুড়ে দেওয়া ও দরপত্রের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করেছে, বিদেশি প্রতিযোগীরা প্রায়ই তাদের স্থানীয় অংশীদারদের ব্যবহার করে ক্রয়প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দরপত্রে বিজয়ী হতে না পারে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে কারচুপির বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে অভিযোগ করেছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো অভিযোগ করেছে যে ঘুষ, প্রতিযোগিতাবিরোধী চর্চা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এসব বিষয় সরকারি দরপত্রে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের পথে বাধা।

মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে সাম্প্রতিক উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইন সংস্কারের মাধ্যমে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বাংলাদেশে নকল ও চোরাচালানের পণ্য সহজেই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে, বিশেষ করে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিভিন্ন আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ডিজিটাল বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইন।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা আছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে রয়েছে আইনি জটিলতা। এটিকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।

শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিক অধিকার, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা- জিএসপি স্থগিত করেছিল। এটি এখনো বহাল আছে।

ঘুষ-দুর্নীতিকে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ঘুষ ও চাঁদা দেওয়ার প্রচুর অভিযোগ থাকলেও দুর্নীতিবিরোধী আইনের প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। লাইসেন্স পেতে ঘুষ দিতে বাধ্য হতে হয় বলেও অভিযোগ করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। লেনদেন ও উপহার অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষ ও চাঁদাবাজি সাধারণ বিষয়। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ হচ্ছে, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ চাওয়ায় লাইসেন্স ও দরপত্রের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। দুর্নীতিবিরোধী প্রধান সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করতে ক্রমাগত প্রস্তাব এসেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button