ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত লুটপাট আরও বেশি
ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার তুলনায় প্রকৃত লুটপাট আরও বেশি বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সম্প্রতি সিপিডি যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা ‘আইসবার্গ’ মাত্র। গতকাল মঙ্গলবার অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সংলাপে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সিপিডির প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাত থেকে গত ১৫ বছরে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের যে তথ্য এসেছে, তা তাদের নিজস্ব কোনো গবেষণা নয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তারা এ হিসাব করেছেন। কবে কোন পত্রিকায় এ বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার তালিকাও সিপিডির কাছে রয়েছে।
গত শনিবার দেশের অর্থনীতির ওপর সিপিডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ে সিপিডির তথ্য নির্জলা মিথ্যা। অনিয়মের তথ্য সিপিডিকে প্রমাণ করতে হবে। সিপিডি এ তথ্য কোথায় পেয়েছে বলে তারা প্রশ্ন করেন।
সরকারের দুই মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। কে এবং কারা বিষয়টি উপস্থাপন করেছে, সে বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ বিষয়বস্তু আগে দেখার দরকার ছিল। তিনি বলেন, এ সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। এটি রাজনীতির জন্যও মঙ্গলজনক নয়। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে এ সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। কারণ, রাজনীতিকে অর্থনীতি থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। ভালো রাজনীতি মানেই ভালো অর্থনীতি।
‘অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে সংলাপ’ শিরোনামে ইআরএফের এ আয়োজন রাজধানীর পল্টনে সংগঠনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আলোচিত সমসাময়িক নানা ইস্যুতে তিনি মত দেন। নিজের বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম চলছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়েছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়েছে। ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করার বিষয় আগে থেকে বলে আসছেন তারা।
তিনি বলেন, শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ নানা শর্ত দিচ্ছে। এগুলো আমলে না নিয়ে এড়িয়ে গেলে রপ্তানি বাজার নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হবে। কোনো সমস্যা নেই মনে করলে একদিন সকালে হয়তো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা চলে আসবে। এতে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই বাণিজ্যনির্ভর। তিনি বলেন, রপ্তানি খাতে কমপ্লায়েন্স এখন অনেক বড় ইস্যু। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের পর জিএসপি প্লাসের জন্য কমপ্লায়েন্স নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। অথচ সাধারণ বাজারে প্রবেশেও এখন অনেক শর্ত।
প্রবাসী আয় প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের মাধ্যমে ২১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে বছরে। তাদের সম্মান দিতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে। রিজার্ভ সংকটে তারাই পারে অর্থনীতিকে কিছুটা রক্ষা করতে। কিছু প্রণোদনায় গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে।
বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঋণ পরিষেবা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। বিদেশি ঋণের ব্যয়ে করা অবকাঠামো প্রকল্প থেকে আয় নিশ্চিত হলে ঠিক আছে। যদি না হয়, তাহলে এ ধরনের ঋণে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামার সম্পদ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেখানে এক কাঠা জমির প্রকৃত দাম ১ কোটি টাকা, সেখানে ১ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তারপরও যদি শতগুণ সম্পদ বাড়ে, তাহলে বাস্তব চিত্র অনুমান করা যায়। কীভাবে এত কম সময়ে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বাড়ল, তা দেখার বিষয়। যাদের সম্পত্তি এত বেড়েছে, সরকার ও নিজ দলের উচিত এসব সম্পত্তির উৎস জানতে চাওয়া। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাজ হবে তাদের সম্পত্তির উৎস বের করা। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের বিষয়ে যদি জনগণের সন্দেহ-অনাস্থা থাকে, তাহলে নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষ তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে, তা ভেবে দেখা দরকার।
অর্থনীতিতে সংস্কার বিষয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টাকা-ডলার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে সাময়িক অসুবিধা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টিও পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। নতুন আয়কর আইন পাস করার পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছে সরকার। আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে, তাই আইন পাস বা সংশোধন করা হয়েছে– এভাবে না দেখে বরং ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে একে দেখতে হবে। আইনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছু মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা লাগবে। কষ্টকর এসব সংস্কারের ফলে সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে।