ব্যাংকের বাইরে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, দুর্নীতির অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের আহ্বায়ক আমির হোসেন আমুর বরিশালের বাসা থেকে নগদ ৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সাধারণ জনগণ। পরে সেনাবাহিনীর কাছে এ অর্থ হস্তান্তর করা হয়। এভাবে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা ব্যাংকে না রেখে কেউ পাচার করেছেন, আবার কেউবা ঘরের মধ্যে সিন্দুকে, আলমারিতে রেখে দিয়েছেন। কেউবা ঘরের মধ্যে ব্যাংকের মতো ভল্ট বানিয়ে রেখে দিয়েছেন। সময় সুযোগ মতো তা পাচার করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে এমন অর্থ রয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব উদ্ধার করা গেলে ব্যাংকিং খাতে চলমান সঙ্কট অনেকাংশেই কেটে যাবে। পাশাপাশি বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়। এ জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গতকাল জানিয়েছেন, মানুষ যখন অনিশ্চয়তায় থাকেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন অবনতি হয় তখন মানুষ আস্থাহীনতায় ভোগেন। আর এ আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে হাতে বেশি অর্থ রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গত জুলাই মাস ও তার আগে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। নিরাপত্তাহীনতায় ছিল মানুষ। এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। নিরাপদে বাড়ি ফেরার ভরসা পাচ্ছে। এখন মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের একটা অংশ আপনা আপনিই ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া দুর্নীতি, ঘুষের মাধ্যমে যারা অর্থ উপার্জন করেছেন তাদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনেক ব্যাংকই গ্রাহকের চাহিদামাফিক অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ সঙ্কট মেটাতে প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। অথচ এক শ্রেণীর মানুষের হাতে টাকার পাহাড় জমে গেছে। অথচ এসব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট বেড়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ১৫ বছরে দেশে দুর্নীতির মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে প্রায় সব শ্রেণীর সরকারদলীয় মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা কেউবা বিদেশে পাচার করেছেন। কেউবা ডলার কিনে ঘরে মজুদ করে রেখেছেন। আবার কেউবা নগদ টাকা ব্যাংকের ভল্টের মতো ঘরে মজুদ করে রেখেছেন। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব অর্থ উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা গেলে ব্যাংকের নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়নির্বাহ বা পণ্য ও সেবা নেয়ার জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু টাকা খরচ করতে হয়। এর বাইরে বাড়তি টাকা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা থাকে। দেশের মোট প্রচলনে থাকা মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমানো টাকা বাদ দিয়ে লোকজনের হাতে কত টাকা আছে সেই তথ্য বের করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের মে মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, মানুষের ব্যাংকে অধিক হারে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ানোর জন্য প্রকৃত সুদহার মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে দুর্নীতির মাধ্যমে যারা অর্থ আয় করেছেন তাদের কাছ থেকে অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় সামনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ হাতে থাকবে না। অর্থাৎ ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাবে। কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।