Bangladesh

ব্যাংকের লকার যেন সুইস ব্যাংক

ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সেফ ডিপোজিট লকার সার্ভিস। অনেকে লকার সার্ভিসও বলেন। এই নিরাপত্তা লকারে ব্যাংকের সবাই নিজ খেয়াল-খুশিমতো যেকোনো কিছু রাখতে পারেন।  কার লকারে কী আছে কেউ জানেন না। এমনকি জানে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকও। কেউ কেউ এই সেফ ডিপোজিট ব্যবস্থাকে দেশের মধ্যেই ‘সুইস ব্যাংক’-এর সঙ্গে তুলনা করছেন। 

সম্প্রতি সাবেক বাংলাদেশ ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর নামে থাকা তিনটি লকার খুলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। সেদিনই আরও শতাধিক বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তার লকারের সন্ধান পান তারা। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের ধারণা, এসকে সুর চৌধুরীর মতোই এই নিরাপত্তা লকার যাদের নামে আছে সবারই অপ্রদর্শিত আয়ে গড়া অর্থ সম্পদ থাকতে পারে। দুদকের এক কর্মকর্তা বলছেন, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই নয়, সারা দেশের প্রতিটি ব্যাংকের শাখাতেই এই লকার সার্ভিস রয়েছে। ব্যাংকে আমানত রাখলে তা যার আমানত তিনি ও ব্যাংকার জানতে পারেন। কিন্তু লকারে কী আছে তা কেউ জানতে পারেন না। ফলে লকারে কী আছে তা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এ যেনো বিকল্প সুইস ব্যাংক! 

দুদক সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সবারই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লকার রয়েছে। যেখানে তারা জমা করেছেন অপ্রদর্শিত আয়। এসব সম্পদ আয়কর রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কী না তা কখনোই কেউ খতিয়ে দেখেননি। তবে এসকে সুর চৌধুরীর পর এবার আরও অনেকের লকার খোলার অপেক্ষায় আছে দুদক। আদালতও এরই মধ্যে খোলার অনুমতি দিয়েছেন। 

সূত্র আরও জানায়, শুধু ব্যাংকের কর্মকর্তারাই নন। দুদক এখন দেশজুড়ে থাকা সব ব্যাংকের লকারগুলোকেই সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। গ্রাহকেরা কে কি রাখছেন তা কেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অজানা থাকবে সে বিষয়টিই প্রশ্নে। দুদক বলছে, বিগত ১৬ বছরে অনেক প্রভাবশালী নেতা, সরকারি কর্মকতা আয়-বহির্র্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। যা সংস্থাটির অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত একশ’র বেশিসংখ্যক মামলাও করেছে দুদক। তবে আড়ালেই রয়ে গেছে তাদের লকার। যেখানে থাকতে পারে সেসব নেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রদর্শিত আয়ে গড়া অর্থ সম্পদ। 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও দলটির এমপি-মন্ত্রীরা অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় আসামি হয়েছেন। কিন্তু এসকে সুর চৌধুরীর লকার খোলার পর ধারণা করা হচ্ছে- এমন বহু লকার আছে। যা দুদকের মামলার তথ্য থেকে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। এসব লকার খুললে বোঝা যাবে কার কী পরিমাণ গোপন অর্থ-সম্পদ রয়েছে। এ ধরনের একটি অনুসন্ধান দুদকের পক্ষ থেকে করার বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।  

দুদক জানায়, গত ২রা ফেব্রুয়ারি রোববার আদালতে আবেদন করা হয়। এসকে সুর চৌধুরীর লকার ভাঙার পর কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসসহ অনেক সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তার ডিপোজিট খোলার অনুমোদনের জন্য আদালতে চিঠি দিয়েছে দুদক। এছাড়া অনেক গ্রাহকের লকারও সেখানে রয়েছে। যা খুললে এই গোপন অর্থ-সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসবে। 

সংস্থাটির পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৬শে জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েন ভল্টে রক্ষিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সাবেক ডেপুটি গভর্নরের সেফ ডিপোজিট তল্লাশিকালে রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য কিছু কর্মকর্তাও সিলগালা করে সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কোটায়ও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ভল্টের লকারে রক্ষিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেফ ডিপোজিটসমূহ তল্লাশি ও ইনভেন্টরি লিস্ট করার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন দাখিলের সদয় অনুমতি দিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় নিরাপত্তা ভল্টে রক্ষিত লকারে সেফ ডিপোজিট খোলার আবেদন আদালতে দাখিল করার পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।

এদিকে, একইদিন চলমান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন লকার না খুলতে পারেন বা লকার থেকে কোনো কিছু না তুলতে পারেন সেজন্য অবরুদ্ধ করার চিঠি দিয়েছে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের স্বাক্ষর করা ওই চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরারব পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- ইতিমধ্যেই সেই চিঠি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লকার খোলার বিষয়ে আদালতের অনুমতি পেয়েছি। এছাড়া সবার লকার ফ্রিজ করার জন্য কমিশন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ চলমান। 

বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এর (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ নুরুল আমীন বলেন, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের লকারে গ্রাহকরা মূলত মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র, অলঙ্কারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করেন। তবে বর্তমানে বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণালঙ্কারসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসও লকারে রাখা হচ্ছে। এজন্য নির্দিষ্ট জামানত ও বার্ষিক ফি প্রদান করতে হয়। তিনি বলেন, লকার সেবার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গ্রাহকের। এখানে ব্যাংকের কোনো দায় নেই। লকারে আয়কর রিটার্নে দেখানো বৈধ জিনিসই রাখা যাবে। অবৈধ হলে তো লকারে রাখাও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি প্রয়োজন মনে করে, তারা আদালতের অনুমতি নিয়ে লকার খুলতে পারে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রয়াত্ত সোনালী ব্যাংকের ছোট লকারের চার্জ আড়াই ২ হাজার, মাঝারিতে সাড়ে ৩ হাজার এবং বড় লকারে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। আর জামানত রাখা হয় ৫ হাজার টাকা। বেসরকারি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। 
এদিকে সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, লকারে গ্রাহকরা বৈধ বা অবৈধ অর্থ-সম্পদ রাখছেন তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। যখন একজন গ্রাহক লকার নিতে চান তাকে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকের নিয়মিত চার্জের বিনিময়ে সেটার চাবি দেয়া হয়। তারপর সেখানে তিনি কী রাখছেন সেটা দেখার সুযোগ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নেই। 

ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে মানবজমিনকে বলেন, সেফ ডিপোজিট লকার দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। সেসব নিয়ম পালন করলেই একজন গ্রাহক লকার পাবেন। তবে গ্রাহক তার লকারে কী রাখছেন দেখার সুযোগ আমাদের নেই। লকার দেয়ার সময় তাকে চাবি দিয়ে দেয়া হয়। আবার ভাঙার সময় তিনিই চাবি খোলেন। তবে সে সময় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন।  

দুদকের নামপ্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার লকারে অর্থ-সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এসব হিসাব তখনই মেলানো যাবে যখন  লকারগুলো খোলা হবে। এরই মধ্যে আমাদের টিম অনুসন্ধান করে যাচ্ছে। যখন যে তথ্য আসছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ যেখানেই যার রয়েছে তাকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে। আমরাও সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor