ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ বছরে সাশ্রয় করতে পারে ১ বিলিয়ন ডলার
‘ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের অর্থনৈতিক সুবিধা স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, বিনিয়োগ ঝুঁকি নিয়ে দুশ্চিন্তা, উচ্চ আমদানি শুল্ক ও চলমান আর্থিক সংকটের কারণে এই খাতটি এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছে।’
দেশের কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ছাদে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসানোর মাধ্যমে বছরে এক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) এক গবেষণা বলছে, যে হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে এবং আগামী বছর আরও বাড়লে, তাতে করে ছাদে সৌর প্যানেল বসানো ভবন মালিকদের জন্য বেশ লাভজনক হবে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ‘ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের অর্থনৈতিক সুবিধা স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, বিনিয়োগ ঝুঁকি নিয়ে দুশ্চিন্তা, উচ্চ আমদানি শুল্ক ও চলমান আর্থিক সংকটের কারণে এই খাতটি এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছে।’
বাংলাদেশে বর্তমানে ছাদে সৌরপ্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে মাত্র ১৬০ দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট।
ব্যাটারি স্টোরেজ সুবিধা ছাড়া এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের লেভেলাইজড কস্ট অব এনার্জি (এলসিওই) হিসাব করা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা পাঁচ টাকা। শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবনের জন্য বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় যথাক্রমে নয় টাকা ৯০ পয়সা ও ১০ টাকা ৫৫ পয়সা।
অর্থাৎ শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবনে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করলে প্রতি ইউনিটের বিপরীতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে চার টাকা ৯০ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা সাশ্রয় করা সম্ভব।
সাধারণত ছাদে বসানো একটি সৌরপ্যানেল থেকে প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই চার ঘণ্টায় ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর চাপ কম হবে। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি কিলোওয়াট যথাক্রমে ১৮ টাকা ৬৮ পয়সা ও ৩৯ টাকা চার পয়সা খরচ পড়ে। এই অপ্রয়োজনীয় খরচটুকু না হলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক সাশ্রয় হতে পারে ফার্নেস তেলের হিসাবে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ও ডিজেলের খরচের হিসাবে এক বিলিয়ন ডলার।
গবেষণাটির প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম মনে করেন, এ ধরনের সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার জাতীয় গ্রিডের ওপর অনেক চাপ কমাবে। যেমন: ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ মাসের মধ্যে আট মাস দৈনিক এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি সময় লোডশেডিং হয়েছে। ওই সময় যদি অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট রুফটপ সোলার থাকতো, তবে লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হতো না, কমতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও।
এভাবে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ দেশের শিল্প উৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে সহযোগিতা করবে, একইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানির পরিমাণ কমিয়ে রিজার্ভ স্থিতিশীল রেখে অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে বলে মনে করেন এই গবেষণা-প্রধান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার জন্য অতীতে বহু ভবনের ছাদে নিম্নমানের সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা হয়েছিল, যা ভবন মালিকদের নতুন করে এ ধরনের প্যানেল স্থাপনের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত সোলার হোম সিস্টেমগুলো গ্রিডের বাইরে থাকা দুই কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে বাজারে কমদামের ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে পড়ায় ওই অর্জনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে।
সরকার ২০১০ সালে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন নিয়ে প্রথম নির্দেশনা জারি করে। গ্রিড সংযোগ পাওয়ার জন্য নতুন ভবন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাদে সৌরপ্যানেল বসানোর বাধ্যবাধকতা দেয়। ২০১৮ সালে নেট মিটারিং নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয় এবং পরের বছর তা সংশোধন করে শিল্প ও ভবনগুলোকে দ্বিমুখী মিটারের মাধ্যমে গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই প্রবিধান নির্দিষ্ট কিছু ভবনকে তাদের অনুমোদিত বিদ্যুৎ চাহিদার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেয়, যেটি ওই ভবনগুলোর বিদ্যুৎ বিল কমাতে অবদান রেখেছে। তবে আইইইএফএর সুপারিশ—একটি ভবনের চাহিদার শতভাগ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হোক।
২০২০ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গ্রিন রিফাইন্যান্সিং স্কিমে ভবনের ছাদের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পকে যুক্ত করে, যেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এতে উত্সাহিত হয়। কিন্তু একইসঙ্গে সরকার ২০২১ সালে সোলার ইনভার্টারের সামগ্রিক আমদানি শুল্ক ১১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করে। স্থানীয় নির্মাতাদের উৎসাহিত করতে আমদানি করা সোলার প্যানেলের ওপর আরও এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়।
গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সোলার মডিউল সংযোজন করে এবং এর প্রধান উপাদানগুলো আমদানি করতে হয়। ‘দেশে উৎপাদিত ইনভার্টারগুলো নিম্নমানের। এ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হলে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুফল পাওয়া থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।’
আমদানি খরচ কমানোর সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের কর-ব্যবস্থা ছাদের সৌরবিদ্যুৎকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
গবেষণায় ছাদে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ধীর অগ্রগতির পিছনে আরও কয়েকটি বাধাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ক্রেতাদের সচেতনতার অভাব, বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা সরবরাহকারীদের ঝুঁকি, ইউটিলিটিগুলোর জন্য ব্যবসায়িক মডেলের অভাব, আর্থিক অবস্থা ও প্রধান স্টেকহোল্ডারদের সক্ষমতার অভাব।
প্রতিবেদন অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩৬ দশমিক চার মিলিয়ন ডলারের স্কিম ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) আর্থিক সুবিধা এ খাতের দ্রুত প্রসারের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রতি এক হাজার মেগাওয়াট ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপনে ৫১০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ থাকা প্রয়োজন।
এতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন রিফাইন্যান্সিং স্কিমটির মাধ্যমে সবচেয়ে কম খরচে ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তহবিল সীমিত হওয়ায় সবাই তা পাবেন না। এ ছাড়াও, এই প্রকল্প আরও ৬৯টি পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে।’
কমছে খরচ; বাড়ছে সুযোগ
আইইইএফএ বলছে, অনেকে এখন ছাদে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থার জন্য অগ্রিম যে খরচ, তাকে আর বাধা হিসেবে দেখছেন না। কারণ এই ব্যবস্থার খরচ প্রতিদিনই কমছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের যে দাম, তা ভিয়েতনামে ২০২০ সালে ‘ফিড-ইন’ দামের চেয়ে বেশি। ভিয়েতনামে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রিডে দিতে পারলে প্রতি কিলোওয়াটের বিপরীতে আট সেন্ট করে পাওয়া যেত। এ কারণে ভিয়েতনাম এক বছরেই নয় হাজার মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল।
বাংলাদেশে ‘ফিড-ইন’ ব্যবস্থা নেই। তবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল কমানো সম্ভব। গবেষণা বলছে, ভিয়েতনামে ‘ফিড-ইন’ দামের কারণে যে আয় হতো, ভবনের মালিকদের জন্য বর্তমান বিদ্যুৎ বিল কাঠামোয় এর চেয়ে বেশি সাশ্রয় সম্ভব।
গবেষণা মতে, রাজস্ব ঘাটতি কমানোর জন্য আগামী বছরের শুরুতেই সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে। ফলে এই সাশ্রয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে, যা ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎকে আরও উৎসাহ দেবে।