Bangladesh

ভাঙা ঘরে শতকোটি টাকার সম্পদ সাবেক রেলমন্ত্রীর ভাতিজার কীর্তি!

সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ভাতিজা তোফায়েল আহমেদ। এক সময় থাকতেন ভাঙা টিনের ঘরে। ছিল না তেমন কোনো আয়-রোজগার। পরিবার চালাতেই হিমশিম খেতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ষোলো বছরের শাসনামলে যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান। চাচার প্রভাব কাজে লাগিয়ে টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। তোফায়েল তখন দম্ভ করে বলতেন ‘আমার কাক্কা ক্যাবিনেট মিনিস্টার’। তার দাপটে দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকার লোকজন ছিলেন কোণঠাসা ও ভীতসন্ত্রস্ত। বর্তমানে তিনি প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। সম্প্রতি তোফায়েল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে।

সরেজমিন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বশুয়ারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সাবেক এমপি মুজিবুল হকের বড় ভাইয়ের ছেলে তোফায়েলের পুরনো টিনের ঘরটি এখনো তার অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়রা জানান, এক সময় যিনি এই ঘরটি সংস্কার করতে পারেননি, এখন তার বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি-জিরাতের অভাব নেই। চাচার দাপট দেখিয়ে শ্যালক তৌহিদকে নিয়ে চৌদ্দগ্রামসহ দক্ষিণ কুমিল্লায় শক্তিশালী ঠিকাদার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। ওই সময় এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ত্রাণ ও পুনর্বাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকাদারি কাজে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন তোফায়েল।

এলজিইডি সূত্র জানায়, ক্ষমতার শেষ ৩ বছরে শুধু চৌদ্দগ্রামেই তোফায়েল তার মেসার্স পলি এন্টারপ্রাইজের নামে ১৮টি বড় প্রকল্পে ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৩ টাকার কাজ হাতিয়ে নেন। আর গত ১৬ বছরে দক্ষিণ কুমিল্লার ৭ উপজেলায় কমপক্ষে হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব কাজেও করেছেন ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি। তার ক্ষমতার প্রভাবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের যথাযথ তদারকিও করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।

স্থানীয়রা জানায়, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ২নং উজিরপুর ইউনিয়নের মিয়াবাজার ভায়া শিবের বাজার-চকলক্ষ্মীপুর সড়কটিতে ব্যয় করা হয় ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬১০ টাকা। ২০২৩ সালের ২১ মে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করা সড়কটিতে এরই মধ্যে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন বলেন, তোফায়েলের ঠিকাদারিতে নির্মিত উপজেলার নারায়ণপুর, তিনপাড়া, শুভপুর এলাকার গ্রামীণ সড়কগুলো ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নবগ্রাম ব্রিজ নির্মাণেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। তোফায়েল যেসব গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ করেছেন তার মধ্যে অধিকাংশেরই সাববেইজ ম্যাকাডম ও কারপেটিংয়ের পরিমাণ সঠিক নেই। রাস্তার পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণেও যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। এসব কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে সরকারি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে।

শ্রীপুরের বাসিন্দা এমরান হোসেন বলেন, তোফায়েলের ভয়ে তার পছন্দের প্রকল্পগুলোতে কেউ শিডিউল কিনত না। তাই একই কাজ বারবার রিটেন্ডারের পর তোফায়েল ১৪-১৫ পার্সেন্ট অতিরিক্ত মূল্যে কাজগুলো ভাগিয়ে নিত। তিনি জানান, উজিরপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর ব্রিজের দুটি গার্ডারে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এলজিইডির পর্যবেক্ষণে অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় দুটি গার্ডার ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু চাচা মজিবুল হকের দাপটে তখন আর ওই গার্ডার ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। কাশিনগর ইউনিয়নের আশ্বদিয়া বারৈয়া ব্রিজ নির্মাণের সময় স্থানীয় জনসাধারণকে বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ওই ব্রিজ নির্মাণের নামে পাশের ডাকাতিয়া নদী ও কাকলি নদী থেকে কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেন তোফায়েল। ব্রিজ ভেঙে ফেলার আগে জনসাধারণের চলাচলের জন্য বিকল্প একটি ব্রিজ নির্মাণের বরাদ্দ থাকলেও তিনি তা করে দেননি। উপজেলার জুপুয়া খেয়াইশ সড়ক নির্মাণ, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার পশ্চিমে বাইপাস সড়ক উন্নয়ন কাজ, মিয়ারবাজার চকলক্ষ্মীপুর সড়কের সংস্কার কাজেও অনিয়ম করেন তিনি। উপজেলার বান্দেরজলা ব্রিজ নির্মাণের কাজে বারবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও তোফায়েলের হুমকি-ধমকির কারণে কেউ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি। পরে অতিরিক্ত মূল্যে কাজটি ভাগিয়ে নেন তিনি।

স্থানীয়রা জানায়, তোফায়েলের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম বিসিক শিল্পনগরীতে ২০ শতাংশের একটি প্লট, বশুয়ারা গ্রামে ৭ বিঘা জমি, চট্টগ্রামে মালেক অ্যান্ড সন্স নামের সিএন্ডএফ এজেন্টের যৌথ মালিকানা। উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের কাদঘর গ্রামের মিজানুর রহমানের সঙ্গে ‘বিডি তারা লিমিটেড’ নামে বৈদ্যুতিক তার হোল্ডার লাইটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির কারখানা রয়েছে তার। ঢাকার নবাবপুরে এ কারখানা গড়ে তোলা হয়। উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের খোরশেদ আলমের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। কারাগারে থাকলেও তোফায়েলের আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে চৌদ্দগ্রামের নারায়ণপুর-নালঘর বাজার সড়কের কাজ, মিয়ারবাজার কাশিপুর এলাকায় ২২ কোটি টাকার ব্রিজ নির্মাণের কাজ, পৌরসভাসংলগ্ন মুন্সিরহাট ইউনিয়নে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। উপজেলার কাশিনগরবাড়িয়া কাকরি নদীর ওপরে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

কুমিল্লা মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি ফখরুল ইসলাম মিঠু বলেন, আমার বাসার পাশেই তোফায়েলের অনেক সম্পদ রয়েছে। নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার মদিনা মসজিদ রোডে ৮ শতকের মূল্যবান একটি প্লট এবং দারুল সাফিদ নামের ভবনে ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফ্ল্যাটগুলো তিনি আত্মীয়স্বজনের নামে রেজিস্ট্রি করেছেন। কিন্তু এসব ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক তোফায়েল। তাছাড়া সিলভার ক্রিসেন্ট ভবনে তার ফ্ল্যাট রয়েছে।

শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান এবং যুবলীগ নেতা শাহজালাল মজুমদার বলেন, তোফায়েল ছিল দক্ষিণ কুমিল্লার শীর্ষ টেন্ডারবাজ। আমরা আওয়ামী লীগ করলেও কার্যত মুজিবুল হক পরিবারের কাছে জিম্মি ছিলাম। তোফায়েলের কারণে বড় কোনো কাজের শিডিউল আমরা কিনতে পারিনি। দক্ষিণ কুমিল্লায় হাজার কোটি টাকার বেশি প্রকল্পের কাজ সে করেছে। তার কাজে অনেক অনিয়ম রয়েছে। দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার দৃষ্টি এড়াতে অনেকটা স্বেচ্ছায় সে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে কারাগারে বসে নিজের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

চৌদ্দগ্রামের ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম বলেন, তোফায়েলের ছিল নিজস্ব সিন্ডিকেট। জায়গা-সম্পত্তির বেচাকেনায় তাকে কমিশন দিতে হতো। তাছাড়া থানার তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের নেপথ্যে ছিল তোফায়েল।

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, শুধু ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি করে শতাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার লাইসেন্সে সম্পাদিত সব উন্নয়ন কাজের তদন্ত করা দরকার।

চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি হিলাল উদ্দিন বলেন, তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরণ ও নাশকতাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার তদন্ত চলছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button