ভাতের হোটেলে দিনে চাঁদা ৮১১
ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্র্জনকারী মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (ছদ্মনাম)। দীর্ঘদিন পোশাক কারখানায় চাকরি করে নতুন বছরে নামমাত্র ৩৫০ টাকা বেড়ে তার বেতন হয়েছিল ১২ হাজার টাকা। যখন মূল্যস্ফীতির বাজারে নিম্নমানের প্রতি কেজি চাল কিনতে হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়, তখন এ টাকায় পরিবারের ভরণপোষণের খরচ সামলানো কষ্টসাধ্য বটে।
তাই তিনি চাকরি ছেড়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় রাজধানীর মতিঝিলের আরামবাগ এলাকার ফুটপাতে ভাতের খুপরি হোটেল গড়ে তোলেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি স্বল্প দামে অন্তত ৫০ জন মানুষের কাছে ১০০ প্লেট ভাত বিক্রি করেন। তার অধিকাংশ ভোক্তা নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ। কিন্তু এখানেও বাদ সেধেছে চাঁদা। অজান্তেই তার প্রত্যেক গ্রাহককে প্রতি প্লেট খাবারে ৮ টাকার বেশি চাঁদা দিতে হচ্ছে।
ফুটপাতে হোটেলের জায়গা পেতে আগেই ৬ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে ইউসুফকে। স্থানভেদে তা ৮-১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিদিন ৮১১ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে লাইনম্যান বাবদ ৫০০, ময়লা অপসারণ বিল ৬০, বিদ্যুৎ বিল (দুই বাতি) ৮০, পুলিশকে ১০০, সাপ্তাহিক বিশেষ চাঁদা ১৫০ ও তৃতীয় লিঙ্গদের ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয় ইউসুফকে।
শুধু ইউসুফ নন, ফুটপাতে ভাতের হোটেল যারা চালান তাদের প্রত্যেককে চাঁদা দেওয়ার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা চাঁদা দিচ্ছেন। আর স্বল্প দামে খেতে আসা লোকজন নিজের অজান্তেই প্রতি প্লেট খাবারে ৮ টাকার বেশি চাঁদা গুনছেন।
জানা গেছে, মতিঝিল এলাকায় অন্তত ৩০০ ভাসমান হোটেল রয়েছে। প্রত্যেক হোটেল থেকে গড়ে ১ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়া হলে প্রতিদিন চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ টাকা এবং মাসে প্রায় ৯ কোটি টাকা।
আরামবাগের ভাসমান হোটেল ব্যবসায়ী ইউসুফ বলেন, ‘গার্মেন্টসে চাকরি করার সময় মনে হয়েছিল অমানবিক কষ্ট করছি। চাকরি ছেড়ে পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখতে কর্জ করে এখানে হোটেল দিয়েছি। এখন দেখছি এখানে যারা চাঁদা নিচ্ছে তারা আরও অমানবিক। কেননা, আমার দোকান খুললেই প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। আমার বিক্রি হোক বা না হোক। চাঁদা আমাকে দিতেই হবে। যাদের কাছে বিচার চাইব তারা নিজেরাই এর সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিন তাদের (পুলিশকে) ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়?’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পল্টনের প্রতিটি এলাকায় রাস্তার মোড়ে কয়েকটি টুল-টেবিল পেতে ভাতের হোটেল গড়ে উঠেছে। এসবের ৮৫ শতাংশ গ্রাহক নিম্ন আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির বাজারে তাদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। এসব দোকানে কম দামে খাবার খেতে আসেন তারা। তবে তারা নিজেদের অজান্তেই প্রতি প্লেট ভাতে ৮ টাকার বেশি চাঁদা দিচ্ছেন।
পল্টন কালভার্ট এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক মহিন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আয় অনুযায়ী দৈনিক তিনবেলা ভাত এসব হোটেলে খেতে হয়। এখানে যারা দোকান চালান তাদের যে চাঁদা দিতে হয় তা জানতাম। কিন্তু এ চাঁদা যে আমাদের ভাতের প্লেট থেকে আদায় হয় তা জানতাম না।’
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফুটপাতের স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীদের মাসোহারা দিতে হয় বলে অভিযোগ শোনা যায়। চাঁদার কারণে এসব ব্যবসায়ী ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এখানে স্বপ্ন গড়তে আসা বহু ব্যবসায়ী চাঁদার টাকা দিতে না পেরে ব্যবসা ছাড়ছেন। ক্ষোভের সৃষ্টিও হয় তাদের মধ্যে। ফলে এসব লোক অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের অনেকে স্বল্পপুঁজির ব্যবসায় নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে ফুটপাতে নানা ব্যবসায় জড়িয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখনই তাদের চাঁদা গুনতে হয়, তখনই তারা এখানে আসা স্বল্প আয়ের মানুষদের থেকে সে টাকা তোলেন। আর অল্প দামে খেতে আসা মানুষগুলো নিজের অজান্তেই বঞ্চিত হন।’
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে যারা রাজনীতি করে তারা চাঁদা তুলছে। প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, এর প্রতিকার যাদের কাছে চাইবেন তারা কি প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম? শোনা যায়, প্রতিকারকারীরা নিজেরাই চাঁদাবাজদের মদদ দেন।’