Hot

ভারততুষ্টির একমুখী বন্ধুত্ব

দুই সমুদ্রবন্দর নৌপথ সড়ক মহাসড়ক রেল ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা নিয়েছে ভারত। অথচ চুক্তি সত্ত্বেও ২১ কি.মি. বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী শিলিগুড়ি করিডোর দিচ্ছে না

ভারতের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা কথায় কথায় ‘কানেকটিভিটি’, ‘ট্রানজিট’, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ কিংবা যোগাযোগ-সংযোগ বাড়ানোর বুলি আওড়ান। বাস্তবে ভারতই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্কের বেলায় কানেকটিভিটির সব সুযোগই বন্ধ ও অবরুদ্ধ করে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি। ভারতের বিশেষ করে ভূমিবেষ্টিত ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশে উৎপাদিত হরেক ধরনের গুণগত উৎকৃষ্টমানের পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অনুরূপ চাহিদা বাংলাদেশের অপর দুই নিকট প্রতিবেশী বন্দর-সুবিধা বিহীন ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) নেপাল, ভুটানেও। উভয় দেশের সরকার এবং সাধারণ জনগণও চায় সুলভে ও সহজ যোগাযোগ সুবিধায় বাংলাদেশী পণ্য পেতে। কিন্তু ভারতের শুল্ক-অশুল্ক বাধা তো আছেই; সেই সাথে সুস্পষ্ট অসহযোগিতায় প্রতিবেশী দেশসমূহের পরস্পরিক যোগাযোগ, ‘কানেকটিভিটি’ কিংবা ‘ট্রানজিটে’র পথ আটকে আছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যোগোযোগ ও ট্রানজিট বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ভারত আকার-আয়তনে গায়ে-গতরে ‘বড়’ দেশ হলেও তার চেয়ে আয়তনে ‘ছোট’ প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি কখনোই ‘বড় মনে’র পরিচয় দিয়ে উদারতার প্রমাণ দেখাতে পারেনি। বরং নিজ স্বার্থ হাসিলে ‘ভারত-নির্ভর’ ও মুখাপেক্ষী করে রাখার একমুখী সংকীর্ণতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল সুর ভারততুষ্টির একমুখী বন্ধুত্ব। প্রতিবেশী ও বৈশি^ক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলগুলো গৌণ হয়ে পড়েছে।

ভারতের বাড়াবাড়ি রকমের ‘দাদাগিরি’তে অতিষ্ঠ প্রতিবেশীরা। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যতীত প্রতিবেশী কোন দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক সুখকর নয়; বরং তিক্ততার। ভারত চায় তার স্বার্থপূরণে প্রত্যেকটি প্রতিবেশী দেশ থাকবে তার পক্ষপুটে। সম্পর্ক হবে একতরফা। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-‘সার্ক’ অচল হয়ে পড়ার কারণ ভারতের অনীহা। ‘সার্ক’ গঠনের মহৎ উদ্দেশ্য থাকলেও হাসিল হয়নি। দীর্ঘদিন যাবত ‘সার্ক’ মৃতপ্রায়। এ অবস্থায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মোট বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ নিজেদের মধ্যে হয়। যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬৮ শতাংশই হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। ভারতের একগুঁয়েমি পরিত্যাগ করে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ সম্পর্কের উদারীকরণ হলেই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ও ‘বড়’ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতই এই অঞ্চলে নেতৃত্বের তকমা পেয়ে যেতো। তবে এহেন একমুখী, একতরফা তথা ভারততুষ্টির সম্পর্ক ওা চুক্তি আখেরে যে টেকসই হয় না অতিসম্প্রতি মালদ্বীপ থেকে ভারতকে যে সরে আসতে হলো তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।

ভারত মাত্র ২১ কিলোমিটার একটি করিডোরে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য নিকটতম প্রতিবেশীকে কোন ছাড় দিচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের দু’টি সমুদ্রবন্দর, নৌপথ ও সড়ক মহাসড়কে ৫শ’ কিলোমিটার ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা ভোগ করছে ভারত। শুধু তাই নয়, গেল ২২ জুন’২০২৪ইং নয়াদিল্লীতে নতুন চুক্তিতে গেদে-দর্শনা হয়ে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী প্রায় চারশ’ কি.মি. রেলপথে ট্রানজিট-করিডোর পেয়েছে। বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির সুযোগে ভারত জবরদস্তি ও যথেচ্ছভাবে বহুমুখী (মাল্টিমোডাল) এসব ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে যেসব ট্রানজিট-করিডোর রুট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে মালামাল আনা-নেয়া করছে এতে আগের তুলনায় ভারতের খরচ কমেছে ৭৬ শতাংশ। লাভ হচ্ছে চার গুণ। অন্যদিকে ভারতের ৯টি রাজ্য (সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের একাংশ এবং সেভেন সিস্টার্স) এবং নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারত মুখাপেক্ষী করে রেখেছে। বহুপাক্ষিক যোগাযোগে দিয়েছে প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের সর্ব-উত্তর জনপদের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা হয়ে ভারতের ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি, নেপালের কাকরভিটা মিলিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং চীনের অবস্থান খুবই কাছাকাছি। ভৌগোলিক অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবেই এটি পাঁচদেশীয় মিলনমেলা করিডোর। মুরগির ঘাড়ের মতো আকৃতি হওয়ায় এটি ‘চিকেন’স নেক’ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাবান্ধার ঠিক বিপরীতেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে অবস্থিত ফুলবাড়ী এবং এর মাত্র ৭ কি.মি. দূরে শিলিগুড়ি। ৩০ কি.মি. দূরত্বের মধ্যে নেপালের কাকরভিটা। প্রায় সমদূরত্বে ভুটান, এরপর নিকটেই চীনের সীমান্ত। অথচ পরস্পর স্বল্প দূরত্বের শিলিগুড়ি করিডোরটি ভারত প্রায় অচল ও ব্লক করে রেখেছে। আন্তঃদেশীয় মিলনমেলায় প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যকার সহযোগিতার দ্বার রুদ্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা থেকে ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব মাত্র ২১ কিলোমিটার। এর প্রস্থ ২১ থেকে স্থানভেদে ৫২ কি.মি.। বাংলাবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে পাঁচদেশীয় মিলনমেলাকে কেন্দ্র্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের সেতুবন্ধন এবং উজ্জ্বল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সংকীর্ণ স্বার্থে তা অকার্যকর করে রেখেছে ভারত।

আধুনিক বিশ্বের ‘খোলা দরজা’ নীতির তোয়াক্কা না করেই পরস্পর সম্পর্কের দুয়ার অবরুদ্ধ করে দিয়েছে ভারত। অথচ সেই ১৬শ’ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শের শাহ শূরী ‘কানেকটিভিটি’র গুরুত্ব প্রমাণ রেখেই ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’ নির্মাণ করান। এটি উত্তরপথ, শাহ রাহে আজম, সড়কে আজম, বাদশাহি সড়ক নামেও পরিচিত। যা এশিয়ার সর্বপ্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়কপথ। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ শের শাহের ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’ বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও (ঢাকা), যশোর দিয়ে ভারতের কলকাতা, কানপুর, দিল্লি, গুজরাট, অমৃতসর হয়ে পশ্চিমে পাকিস্তানের লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি এবং পেশোয়ার, আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যদিকে আধুনিক বিশে^ এসে নিকট প্রতিবেশীদের ‘পর মুখাপেক্ষী’ যোগাযোগ ব্যবস্থার জালে আটকে রেখে একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা সাজাচ্ছে ভারত।

করিডোরটি কার্যকর করতে ১৯৯৮ সালে ‘বাংলাদেশ-ভারত ফুলবাড়ী চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। চুক্তির সুবাদে ভারতের ক্ষুদ্র এই করিডোর রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশ-নেপাল-ভারত-ভুটানের পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্যিক চলাচলে প্রবেশাধিকার লাভ করে। অথচ ২৬ বছর অতিবাহিত হলেও ফুলবাড়ী চুক্তির বাস্তবায়ন ঝুলে আছে। ছোট্ট করিডোরটি অকেজো করে রাখায় ৪টি দেশের আমদানি-রফতানির বহুমুখী সম্ভাবনা আটকে আছে। নেপাল ও ভুটানের সাথে বাণিজ্য সচল রাখতে হলে কড়িডোরটি গুরুত্বপূর্ণ। নেপাল ১৯৭৬ ও ভুটান ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। নানা জটিলতা আর অনিশ্চয়তার চক্করে পড়ে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট বাণিজ্যের সম্ভাবনা থমকে আছে। ২০০২ সালে ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ এ অঞ্চলে একটি ‘মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ অঞ্চলে অবাধে চার দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের অঙ্গীকার করা হয়। ভারতের অসহযোগিতার মুখে তাও হয় রুদ্ধ।

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান পরস্পর প্রতিযোগিতামূলক কম দামে পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি করতে পারছে না। বাণিজ্যিক যোগাযোগে বঞ্চিত রয়েছে দেশগুলো। বরং উল্টো বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতের সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে পাহাড়সম ঘাটতির বোঝা টানতে ‘বাধ্য’ হচ্ছে। নেপাল ও ভুটানে সরাসরি পণ্য পাঠাতে ভারতের মাত্র ২১ কি.মি. শিলিগুড়ি করিডোড় ব্যবহারের অনুমতি বাংলাদেশকে না দেয়ার পেছনে বিশ্লেষকগণ দু’টি কারণ দেখছেন। প্রথমত, নেপাল ও ভুটানে ভারতের একচেটিয়া বাজার হারানোর ভয় এবং দ্বিতীয়ত, ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের দরকষাকষির দুর্বলতা। নেপাল ও ভুটানের আমদানির ৯০ শতাংশের উৎস ভারত। বাদবাকি মাত্র ১০ ভাগ অন্য দেশ থেকে আমদানি হলেও এতে ব্যবহার করতে হয় কলকাতা বন্দর। যা ট্রান্সশিপমেন্টে নেপাল ও ভুটানে পৌঁছে দেয় ভারতীয় ট্রাক। এখন বাংলাদেশ যদি শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে আগের চুক্তি মাফিক ট্রানজিট সুবিধা পায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকেই কম মূল্যে সরাসরি পণ্য নিতে আগ্রহী হবে নেপাল ও ভুটান। তাছাড়া কলকাতা বন্দরের পরিবর্তে মোংলা বন্দর দিয়ে পদ্মা ও যমুনা সেতু দু’টি ব্যবহার করে পণ্যসামগ্রী পরিবহন আরো সহজ ও দ্রুত হবে নেপাল-ভুটানের জন্য। অনুরূপ সুবিধা হবে দুই দেশ থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও। সেই সুযোগই আটকে রেখেছে ভারত।

প্রবীণ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান : ভারতকে বাংলাদেশের দুই সমুদ্রবন্দরে ও সড়ক-মহাসড়কে ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার পর এবার রেল ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা প্রদান প্রসঙ্গে প্রবীণ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান গতকাল বলেন, এসব বিষয়ে চুক্তির আগে জনমত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া থাকা উচিৎ। বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশগুলোর সুবিধা-অসুবিধার তোয়াক্কা করছে না ভারত। একাই সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। আমরা কী পাচ্ছি? ইউরোপের সাথে তুলনা করলে চলবে না। আমরা এই উপমহাদেশে বাস করি। আমাদের সংস্কৃতি একতরফা সুবিধা এলাউ করে না। বন্ধুত্ব হতে হবে পরস্পরের চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ায় সমতার ভিত্তিতে। অসমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব হয় না। ওয়ান-টু-ওয়ান যাচাই হতে হবে। আমরা কী দিয়েছি তারা কী দিলো এর হিসাব প্রয়োজন। দিবো আর নিবো, মিলবো আর মিলাবোÑ এটাই হবে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের ভিত্তি।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম : একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কলামিস্ট, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ভারত ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা পেতে বাংলাদেশের সীমানা ব্যবহার করবে। অথচ ভারতের একতরফা ও একগুঁয়েমীর জন্য বাংলাবান্ধা হয়ে ফুলবাড়ী-শিলিগুড়ি করিডোরটি ব্যবহার করতে দেবে না। এই করিডোর নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে দিলে তাদের চীনকে ভয়। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের অর্থনীতি ভারতের উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসুক তা ভারত কখনোই চাইবে না। নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আদৌ আসবে কিনা সংশয় রয়েছে। ভারত পদে পদে একতরফা সুবিধা নিয়েই যাচ্ছে। ভারত তার অর্থনৈতিক ঐবমবসড়হু (আধিপত্যবাদী) অবস্থান থেকে সরবে না। তার অনীহার কারণেই ‘সার্ক’ ঝুলে আছে। ভারত চাইছে না ‘সার্ক’ কার্যকর হোক। ফলে মৃত অবস্থায় থেকে যাবে ‘সার্ক’।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের প্রফেসর ড. মো. শামছুল হক : বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েট-এর প্রফেসর ড. মো. শামছুল হক বলেন, ভারতের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশ আশপাশের দেশসমূহের জন্য উদার হতে পারছে না। ভারত ‘বড়’ দেশ হিসেবে যে আচরণ করা উচিৎ ছিল তার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। যা অত্যন্ত হতাশা ও দুর্ভাগ্যজনক। সুবিধা দেয়া ও নেয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ শেয়ারিং হলে মাল্টিমোডাল ট্রানজিট থেকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশের জন্যই উইনÑউইন সিচুয়েশন হতে পারতো। ভারতের ভাবখানা এমন যে, আমিই সব সার্ভিস দিচ্ছি তো! অথচ ভারত আমাদের দেশের অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহার করছে। তিনি আরো বলেন, উন্নত বিশে^র বড় দেশগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি সবসময়ই উদার হয়ে থাকে। কিন্তু ‘বড়’ দেশ হিসেবে উদারতা দেখাতে পারেনা ভারত। শুধুই একপক্ষীয় ছাড়া বহুপক্ষীয় স্বার্থ সমুন্নত করার গুরুত্ব নেই ভারতের কাছে। তবে একতরফা বা একমুখী সম্পর্ক আখেরে যে টেকসই হয় না তার জ্বলন্ত নজির সম্প্রতি মালদ্বীপ থেকে ভারতকে সরে আসতে হয়েছে।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেখক-কলামিস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি নয়াদিল্লী সফরে আমরা কী পেয়েছি? তিস্তার পানি কী পেয়েছি? বরং ভারতকে রেল ট্রানজিট-করিডোর সুবিধাদানসহ দশ দফা চুক্তি সবই একমুখী সিদ্ধান্ত। তাতে ভারত একাই লাভবান, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সিদ্ধান্ত ও চুক্তি আত্মঘাতি। দেশ ও জাতির স্বার্থ পরিপন্থী। যে কোন চুক্তিতে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে হবে। এই চুক্তিতে ভারতের স্বার্থই পূরণ হয়েছে। আমাদের দেশের উপর দিয়ে যাবেন অথচ টাকা দেবেন না, তা কীভাবে হতে পারে!

‘ভারতের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশ কি কূটনৈতিক দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে’? : উপরোক্ত শিরোনামে শুক্রবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো দাবি করছে ভারতের সাথে আলোচনায় নিজেদের দাবি বা স্বার্থ আদায়ে কূটনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছে না বাংলাদেশ। এ কারণেই ভারত তার চাওয়াগুলো আদায় করতে পারলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিরোধী নেতারা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি হওয়া ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির’ কারণেই আলোচনার টেবিলে শক্তভাবে কথা বলতে পারছে না বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ভারতীয়দের সামনে সরকার দুর্বল বলেই কূটনীতিকরা কাজ করতে পারে না। আর সে কারণেই ভারত তার ইচ্ছেমতো সবকিছু পাচ্ছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের মধ্যে দশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সামাজিক মাধ্যমে রেল ট্রানজিটসহ কিছু বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই বলে সমালোচনা করছেন যে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ, অর্থাৎ বাংলাদেশের কূটনীতিক অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের সক্ষমতার ঘাটতিও এখানে বড় সংকট হিসেবে মনে হচ্ছে অনেকের কাছে।

ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, আমলা বা কূটনীতিকরা পারছে না। তবে এজন্য সরকারই দায়ী। তারা ভারতকে সব দিয়ে বসে থাকলে আমলাদের করণীয়ই বা কী থাকে? তিস্তার পানি আনতে পারেনি। অথচ সরকার তাদের তিস্তা মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হবার সুযোগ দিয়েছে। এটা কোন দক্ষ আমলাতন্ত্রের কাজ হতে পারে না। এটা হয়েছে কারণ সরকারের ভারত তোষণ নীতির বিপরীতে গিয়ে পেশাগত অবস্থান তুলে ধরার মতো পরিবেশটাই নেই। অবশ্য এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদ সদস্য ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা নেই, তবে ব্রিটিশদের হাতে তৈরি ভারতীয় আমলাতন্ত্র ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পুষ্ট এবং অনেক পরিপক্ব’।

বাংলাদেশ শুধু ট্রানজিটের ‘পথ’? : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ লেখক প্রফেসর এম এম আকাশ সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাংলাদেশ শুধুই ট্রানজিটের ‘পথ’ হয়েই থাকবে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। মোংলা বন্দর থেকে ভারত যদি ট্রানজিট সুবিধা নেয়, বাংলাদেশকেও বাংলাবান্ধা দিয়ে নেপালে বা অন্য কোন জায়গা দিয়ে নেপাল-ভুটানে যাওয়ার ট্রানজিট সুবিধা ভারতকে দিতে হবে। এটা নিয়ে বাংলাদেশের বার্গেইন করা উচিৎ। যাতে এটা মাল্টিল্যাটারাল (বহুপাক্ষিক) হয়। সেই সুযোগ বাংলাদেশের আছে। এমন না হলে দু’টি সার্বভৌম দেশের মধ্যে একটা সমতার সম্পর্ক হল না। বাংলাদেশের সাথে নেপালের সরাসরি সীমান্ত না থাকায় বাংলাদেশ বাংলাবান্ধা সীমান্ত থেকে ভারতের জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ী হয়ে স্থলপথে নেপালের কাকরভিটা যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ যথেষ্ট দরকষাকষি করেনি। এসব কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার এসব চুক্তি অসম।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button