ভারতবর্ষের রাজপ্রাসাদে হিন্দু দেব-দেবীর ছবি এঁকেছিলেন বিশ্বযুদ্ধে দেশছাড়া পোলিশ এ শিল্পী
দেশ ছেড়ে সুদূর ভারতে নিজেকে সফল চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নর্বলিন। তিনি এঁকেছিলেন হিন্দু দেব-দেবীদের দৃষ্টিনন্দন সব ম্যুরাল, মহাভারত ও রামায়নের বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে ছবি, ভারতবর্ষের বাঘ, লেপার্ড ও হাতির মতো প্রখ্যাত সব প্রাণী।
১৯৩৯ সাল। জার্মান ট্যাংক আর সেনারা পোল্যান্ডে হানা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জনৈক পোলিশ শিল্পী ও তার সিনে-তারকা স্ত্রী তাদের জুয়েলারি বিক্রি করে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ছাড়েন।
যুদ্ধের ডামাডোলে স্টেফান নর্বলিন ও লেনা ভিটেমাটি এবং শিল্পচর্চা ছেড়ে প্রথমে আমেরিকা যান। সেখান থেকে রোমানিয়া, তুরস্ক ও ইরাক হয়ে শেষকালে থিতু হন ব্রিটিশ ভারতে। ভারতবর্ষে পরবর্তী ছয় বছর কাটিয়েছিলেন এ দম্পতি।
এ অর্ধযুগে নর্বলিন ভারতের স্থানীয় শিল্পী ও মহারাজাদের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে চিত্রশিল্পী হিসেবে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় ভারতের কিছু শ্রেষ্ঠতম চিত্রকর্ম; যেগুলোতে পশ্চিমা নান্দনিকতার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটেছিল ভারতীয় আইকনোগ্রাফির।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভারতীয় মহারাজা চিত্রকর্ম দিয়ে তাদের প্রাসাদ সাজানোর জন্য নর্বলিনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অনেক রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সজ্জার কাজও করেছিলেন পোলিশ এ চিত্রকর।
নর্বলিনের আঁকা দ্য হিরোজ অব মহাভারত। ছবি: ইউটিব থেকে সংগৃহীত [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
দেশ ছেড়ে সুদূর ভারতে নিজেকে সফল চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নর্বলিন। তিনি এঁকেছিলেন হিন্দু দেব-দেবীদের দৃষ্টিনন্দন সব ম্যুরাল, মহাভারত ও রামায়নের বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে ছবি, ভারতবর্ষের বাঘ, লেপার্ড ও হাতির মতো প্রখ্যাত সব প্রাণী।
করদ রাজ্য যোধপুরের রাজার বাসস্থান রাজস্থানের উমেদ ভবন প্রাসাদ ছাড়াও গুজরাটের মোরবির শাসকদের প্রাসাদে নর্বলিনের আঁকা ছবি রয়েছে।
বিহারের রামগড়ের মহারাজের পোর্ট্রেটও এঁকেছিলেন স্টেফান নর্বলিন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব ছবি হারিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন পোলিশ এ চিত্রশিল্পীর কাজের বিশেষজ্ঞ ক্লস-উলরিচ সাইমন।
নর্বলিনের আঁকা একটি চিত্রকর্ম। ছবি: সংগৃহীত
ওয়ারশতে ১৮৯২ সালে এক ধনী শিল্প পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্টেফান নর্বলিন। বাবা চেয়েছিলেন নর্বলিন বড় হয়ে ব্যবসায়ী হবেন। সেজন্য ছেলেকে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে ব্যবসায় শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু নর্বলিনের আগ্রহ ছিল চিত্রশিল্পে। তার বংশের ইতিহাস ঘাঁটলে এ শিল্পের নজির পাওয়া যায়; নর্বলিনের এক বৃদ্ধ চাচা ছিলেন একজন বিখ্যাত ফরাসি শিল্পীর বংশধর।
তরুণ বয়সে নর্বলিন পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ইউরোপে যাত্রা করেন। ইউরোপের অসংখ্য গ্যালারি চষে বেড়িয়েছিলেন তিনি। বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ম্যাগাজিনের জন্য অলংকরণ তৈরির কাজও করেন তিনি।
এরপর ওয়ারশতে ফিরে গ্রাফিক শিল্পী, মঞ্চ নকশাকার ও বইয়ের অলংকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। স্থানীয় বনেদি গোষ্ঠীতে তার বেশ নামডাক ছড়ায়। তবে নর্বলিনের খ্যাতি সবচেয়ে বেশি ছিল পোর্ট্রেট আঁকায়।
নর্বলিনের আঁকা রাম-রাবনের যুদ্ধ। ছবি: ইন্ডিয়ান হিস্টোরি পিকস/এক্স [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
১৯৩৩ সালে লেনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাকে বিয়ে করেন নর্বলিন। সিনেমা জগতের তারকা লেনা ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রভাবশালী এ দম্পতির জীবন ওয়ারশতে বেশ ভালোই কাটছিল।
কিন্তু তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুন্দুভি বেজে উঠল; সব উলটপালট হয়ে গেল তাদের জন্য। আশ্রয় নিতে হলো সুদূর ভারতবর্ষে।
নর্বলিন–লেনা প্রথমে বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) পৌঁছান। সেখানে বাস শুরু করেন তারা। নর্বলিন বোম্বের বড় বড় গ্যালারিতে তার ছবি প্রদর্শন করতে শুরু করেন। নজরে পড়েন স্থানীয় ধনী শিল্প সমঝদারদের।
১৯৩০ ও ‘৪০-এর দশকে ইউরোপে বিপুল জনপ্রিয় ছিল আর্ট ডেকো স্টাইল। ভারতে তখনো এ ধারা বিশেষ ছড়ায়নি। কিন্তু ভারতবর্ষের মহারাজাদের অনেকের সন্তান ইউরোপে পড়তে যাওয়ার সুবাদে এ ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।
উমেদ ভবন প্রাসাদে নর্বলিনের আঁকা এ ছবিতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মোগলদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধ। ছবি: ইন্ডিয়ান হিস্টোরি পিকস/এক্স [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
আর তাই মোরবিতে নতুন প্রাসাদ বানানোর সময় মহারাজা মহেন্দ্রসিংজির ছেলে চেয়েছিলেন প্রাসাদটির নকশা ও ভেতরের সাজসজ্জা আর্ট ডেকো স্টাইলে হোক।
তিনি নর্বলিনকে দায়িত্ব দেন তার চিত্রকর্ম দিয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তর সাজাতে। নর্বলিন তখন শিকারের দৃশ্য, হিন্দু দেবতা শিবের ধ্যান, যুবরাজের পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেট এবং স্থানীয় উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ছবি দিয়ে বিশালাকৃতির একটি ম্যুরাল তৈরি করেন।
নর্বলিন এরপর ডাক পান উমেদ সিংয়ের কাছ থেকে। যোধপুরের রাজপ্রাসাদের ডেকোরেশন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ভার পড়ে তার ওপর। জানা যায়, লন্ডন থেকে উমেদ সিং কিছু ফার্নিচার আনছিলেন। কিন্তু জাহাজে আনার পথে দুর্ঘটনায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এ কারণেই প্রাসাদ সাজানোর দায়িত্ব চলে যায় নর্বলিনের কাছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথ চালাচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। নর্বলিনের আঁকা ছবি। ছবি: ইন্ডিয়ান হিস্টোরি পিকস/এক্স [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
এ প্রাসাদে নর্বলিনের কাজের মধ্যে রয়েছে দেবী দুর্গার একটি ম্যুরাল। দুর্গার চিরায়ত সিংহবাহিনী–দশপ্রহরণধারিণী রূপকেই ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
প্রাসাদের অরিয়েন্টাল রুম নামক একটি কক্ষে শোভা পেয়েছে নর্বলিনের আঁকা ছয়টি ম্যুরালের একটি সিরিজ। এ ম্যুরালে রয়েছে রামায়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। রাবণের সীতাহরণ ও সীতার অগ্নিপরীক্ষার দৃশ্যও ম্যুরালটিতে রেখেছেন নর্বলিন।
উমেদ ভবন প্রাসাদের বেশ কয়েকটি কক্ষের সাজসজ্জা পুরোটাই তৈরি হয়েছে নর্বলিনের নকশায়। এমনকি খোদ রাজা ও রানীর খাস কামরা, দরবারকক্ষ ও খাবারকক্ষের সাজসজ্জার দায়িত্বও ছিল তার।
নর্বলিনের আঁকা দেবী দুর্গার চিত্রকর্ম। ছবি: ইন্ডিয়ান হিস্টোরি পিকস/এক্স [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
যত্নের অভাব, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে নর্বলিনের অনেক চিত্রকর্ম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে সেগুলো পোলিশ সরকার পুনরুদ্ধার [রিস্টোরেশন] করেছে। নর্বলিনের কাজ পোল্যান্ড ও ভারতে প্রদর্শিত হলেও এখনো তিনি অনেকের কাছে অজানা। এর কারণ হয়তো ভারত থেকে আমেরিকা যাওয়ার পর নর্বলিনের সাফল্যে ভাটা পড়েছিল বলে।
ভারত ত্যাগ করে আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন নর্বলিন–লেনা দম্পতি। কিন্তু সেখানকার শিল্পীসমাজ পোলিশ এ শিল্পীকে আপন করে নেয়নি।
আমেরিকায় ছবি আঁকার বেশি কাজ পাননি স্টেফান নর্বলিন। এদিকে গ্লুকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তিও ক্ষয়ে আসছিল তার। তাই একপর্যায়ে ছবি আঁকা পুরোপুরি ছেড়ে দেন তিনি। এক সময়ের বিখ্যাত তারকা স্ত্রী পরিবারের ভরণপোষণের জন্য স্থানীয় একটি বিউটি সেলুনে ম্যানিকিউরিস্ট হিসেবে কাজ নেন।
নর্বলিনের আঁকা রাবণের সীতাহরণ। ছবি: ইন্ডিয়ান হিস্টোরি পিকস/এক্স [ভায়া স্ক্রল ডটইন]
কিন্তু তা-তেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এক পর্যায়ে বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেন নর্বলিন। ১৯৫২ সালে আত্মঘাতী হন এ শিল্পী। পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চাইছিলেন না তিনি আর।
তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে তার কাজগুলোও বিস্মরণের অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকে সেগুলো নতুন করে খুঁজে বের করেন ক্লস-উলরিচ সাইমন।
তারপর থেকে নর্বলিনের কাজকে প্রকাশ্যে আনার জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি।