ভারতীয় হয়েও সরকারের চোখে পাকিস্তানের নাগরিক ৮০ বছরের বৃদ্ধ, করুণ মৃত্যুর দায় কার: পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত এপ্রিলে সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলামাবাদের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উভয় দেশ পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এর আগে দুই দেশ পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নেয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয় নয়াদিল্লি। পাকিস্তানও একই নির্দেশ দেয়। সরকারি নির্দেশের কারণে ভারতের কাশ্মীর এক বৃদ্ধ নাগরিক চরম হয়রানির শিকার হন এমনকি শেষ পর্যন্ত মারা যান। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ভারতের সংবাদভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল স্ক্রল ডট ইন সাংবাদিক সাফওয়াত জারগার।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরের ভাট পরিবারের বাড়ির দরজায় ২৬ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে কেউ একজন কড়া নাড়েন।
দরজায় টোকা দেওয়া ওই ব্যক্তি ছিলেন জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি ভাট পরিবারের এক সদস্যের জন্য ‘ভারত ত্যাগের নোটিশ’ নিয়ে এসেছেন। যাঁকে ভারত ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে, তাঁর নাম আবদুল ওয়াহিদ ভাট। ৮০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ পঙ্গুত্বের কারণে চলাফেরা করতে পারেন না।
চার দিন আগে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। এ ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
ভারতের দাবি, পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যা ইসলামাবাদ অস্বীকার করেছে। এই ঘটনায় উভয় দেশ বেশ কয়েকটি পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নেয়। ভারত সরকার নিজ দেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি নাগরিকদের চিহ্নিত করে তাদের দেশ ত্যাগ নিশ্চিত করতে রাজ্যগুলোর প্রতি নির্দেশ দেয়। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের কর্মকর্তারা সেই নির্দেশ পালন করতেই ভাটের বাড়িতে এসেছিলেন।
তিন দিন ধরে ভাটের পরিবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেন। তাঁরা ভাটকে পাকিস্তানে পাঠানোর আদেশ আটকানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের দাবি, ভাট পাকিস্তানি নাগরিক নন। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, তিনি পাকিস্তানি নাগরিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাটের এক আত্মীয় স্ক্রল ডট ইনকে বলেন, ‘তাঁর জন্ম শ্রীনগরে। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাশ্মীরেই কেটেছে। ১৫ বছর পাকিস্তানে থাকলেও ১৯৮০ সাল থেকে তিনি টানা কাশ্মীরে বসবাস করে আসছিলেন।’
ভাটের আত্মীয়রা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের কাছে তাঁর স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। তিনি যে কথা বলতে বা দাঁড়াতে অক্ষম এবং সাহায্য ছাড়া একা চলাফেরা করতে পারেন না, তা সেখানে উল্লেখ ছিল।
অন্যদিকে ভাটকে পাকিস্তানের ঠিক কোনো জায়গায় পাঠানো হবে, কর্তৃপক্ষের কাছে তা জানা ছিল না।
আত্মীয়দের অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৯ এপ্রিল সকালে পঙ্গু ও অচল আবদুল ওয়াহিদ ভাটকে পাঞ্জাবের আটারি সীমান্তের উদ্দেশ্যে একটি বাসে তুলে দেয় জম্মু-কাশ্মীরের পুলিশ।
ভাটের আত্মীয়রা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের কাছে তাঁর স্বাস্থ্যবিষয়ক রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। তিনি যে কথা বলতে বা দাঁড়াতে অক্ষম এবং সাহায্য ছাড়া একা চলাফেরা করতে পারেন না, তা সেখানে উল্লেখ ছিল।
ভাটের সঙ্গে তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিলেন না। ছিল আরও প্রায় ৪০ জন মানুষ, যাদের পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে ভারত ত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। ভাটের মতো এসব ব্যক্তিকেও জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাসে তোলা হয়েছে।
পরদিন ভারতীয় কর্মকর্তারা এসব ব্যক্তির বহিষ্কারাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির চেষ্টা করছিলেন। তখন ভারত-পাকিস্তানের সীমানায় আটারির তল্লাশিচৌকির বাইরে বাসে নিঃসঙ্গ ও অবহেলিতভাবে অপেক্ষমাণ অবস্থায় ভাট মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে কিছু ওষুধ, কিছু ডায়াপার, প্রেসক্রিপশন, একটি কম্বল এবং একটি পানির বোতল ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
জীবনের মতো ভাটের মৃত্যুতেও ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতার ছায়া পড়েছে। সীমান্তকেন্দ্রিক ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতাই যেন আবদুল ওয়াহিদ ভাটের জীবনকে গ্রাস করল।
জীবন বদলে দেওয়া এক সফর
অনেকের মত আবদুল ওয়াহিদ ভাটের জীবনও ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ-ভারতের দেশভাগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের জীবনে দেশ ভাগের নানা ছাপ দেখা যায়।
শ্রীনগরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র খানিয়ারে ভাটের জন্ম। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ভাটের বাবা শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাটের এক আত্মীয় স্ক্রল ডট ইনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ওই আত্মীয় জানান, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৬৫ সালে এক খালার সঙ্গে পাকিস্তানে যান ভাট। দেশ ভাগের পর ভাটের এই খালার দুই ছেলে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘কোনো ভিসা বা অন্য কোনো কাগজপত্র ছাড়াই তাঁরা (ভাট ও খালা) পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গিয়েছিল। তখন কাশ্মীরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেত শুধু একটি বৈধ অনুমতিপত্র লাগত, যা তাঁদের ছিল।’
নিউইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক শাহলা হুসেইন বলেন, ১৯৬০–এর দশকে পারমিট ব্যবস্থা বা বৈধ অনুমতিপত্র নিয়ে কাশ্মীরিদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার সাধারণ নিয়ম ছিল। দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালে এটা চালু হয়েছিল।
স্ক্রল ডট ইকে ই-মেইলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাহলা হুসেইন বলেন, ‘এটি (পারমিট ব্যবস্থা) ১৯৫২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে গৃহীত পাসপোর্ট ও ভিসা ব্যবস্থার থেকে আলাদা ছিল।’
২০২১ সালে প্রকাশিত ‘কাশ্মীর ইন দ্য আফটারমেথ অব পার্টিশন’ বইয়ের লেখক শাহলা হুসেইন বলেন, ওই পারের কাশ্মীরে যাওয়ার অনুমতিপত্র (পারমিট) ‘রাজ্য সরকারই ইস্যু করত এবং এর জন্য দীর্ঘ ও জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতো।’ এই লেখকের ধারণা, ‘এই অনুমতিপত্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভবত ষাটের দশকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গিয়েছিলেন ভাট।’
কিন্তু ভাটের ভাগ্যে যে গুরুতর খারাপ কিছু ছিল, তা তো আর তাঁর জানা ছিল না।
পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পা রাখার কিছুদিন পরই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। ১৯৬৫ সালের আগস্টে কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশ সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালেই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান প্রথমবারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। একই বিষয়ে ১৯৬৫ সালেরটি ছিল দ্বিতীয় যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে দুই প্রতিবেশী দেশের এই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল।
তাঁর জন্ম শ্রীনগরে। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাশ্মীরেই কেটেছে। ১৫ বছর পাকিস্তানে থাকলেও ১৯৮০ সাল থেকে তিনি টানা কাশ্মীরে বসবাস করে আসছিলেন।
স্ক্রলডটকে আবদুল ওয়াহিদ ভাটের এক আত্মীয়
ওই আত্মীয় বলেন, ‘ভাট ও তাঁর খালা আর ফিরতে পারেননি, তাঁরা সেখানেই আটকে পড়েন। কিছুদিন পর সীমান্ত খোলে। কিন্তু ভাটের খালা পাকিস্তানে তাঁর ছেলেদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন (ভারতের) কাশ্মীরে থাকা ভাটের পরিবারও তাঁকে ওখানেই থেকে যেতে বলে।’
পাঁচ বছর পর ভাটের কাছে বাড়ি থেকে একটি খবর আসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আত্মীয় বলেন, ‘১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে ভাটের মা মারা যান। এই মৃত্যু ভাটের বাবার জীবনে গভীর শূন্যতা তৈরি করে। তখনই তিনি ছেলেকে (ভারতনিয়ন্ত্রিত) কাশ্মীরে ফিরে আসতে বলেন।’
কিন্তু তত দিনে কাশ্মীরে ফেরা আগের মতো সহজ ছিল না। কারণ, যুদ্ধের কারণে সীমান্ত পারাপারের নিয়ম আরও জটিল হয়ে পড়েছিল।
শাহলা হুসেইন বলেন, ১৯৭২ সালে শিমলা চুক্তির পর যুদ্ধবিরতি রেখাটাই ‘নিয়ন্ত্রণরেখায়’ পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপরই এই রেখা পার হওয়া অনেকটা সীমিত হয়ে পড়েছিল।’
এই গবেষক বলেন, ‘১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরেও অনুমতিপত্র ব্যবস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু ছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় থাকা ব্যক্তিদের জন্য ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঢোকা অনেক কঠিন হয়ে উঠেছিল। এমন ব্যক্তিদের প্রায়ই সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখা হতো এবং তাঁদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হতো।’
ভারত-পাকিস্তানের সীমানায় আটারির তল্লাশিচৌকির বাইরে বাসে নিঃসঙ্গ ও অবহেলিতভাবে অপেক্ষমাণ অবস্থায় ভাট মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে কিছু ওষুধ, কিছু ডায়াপার, প্রেসক্রিপশন, একটি কম্বল এবং একটি পানি বোতল ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ভাট পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গিয়েছিলেন এমন এক প্রক্রিয়ায়, যেখানে পাসপোর্ট বা ভিসার প্রয়োজন হয়নি। তাই, তাঁর সঙ্গে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র ছিল না। এই পরিস্থিতিতে পরে যখন তিনি শ্রীনগরে নিজের বাড়িতে ফিরতে চাইলেন, তখন তাঁকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তখন ‘ভাটকে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয়েছিল’ বলে জানান তাঁর ওই আত্মীয়।
এভাবে আরও এক দশক কেটে যায়। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রায় ১৫ বছর থাকার পর অবশেষে ১৯৮০ সালে ভাট ভারতের মাটিতে পা রাখেন। আত্মীয়টি বলেন, ‘তখন তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। হ্যাঁ, সেই একই সীমান্ত যেখানে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
নতুন জীবন
কাশ্মীরে ফিরে এসে আবদুল ওয়াহিদ ভাট শ্রীনগরের খানইয়ার এলাকায় তাঁর পৈতৃক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। তিনি একটি পোলট্রির ব্যবসা শুরু করেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন।
ভাটের জীবনের এই সময়টা শান্তিপূর্ণ ছিল। তখনো কাশ্মীর উপত্যকায় স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়নি।
তবে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ছায়া কখনো ভাটের পিছু ছাড়েনি। দেশে ফেরার কয়েক বছরের মধ্যেই জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ‘ভারতে অতিরিক্ত সময় অবস্থানের’ অভিযোগে একটি এফআইআর দায়ের করে।
এই মামলায় অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। ভাটের আত্মীয় বলেন, ‘তবে আদালত তাঁকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। তখন আদালত বলেছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ (ভাটের বিরুদ্ধে) অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে।’
এর অর্থ দাঁড়ায়, ভারত সরকার আবদুল ওয়াহিদ ভাটকে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
১৯৬০–এর দশকে পারমিট ব্যবস্থা বা বৈধ অনুমতিপত্র নিয়ে কাশ্মীরিদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার সাধারণ নিয়ম ছিল। দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালে এটা চালু হয়েছিল।
শাহলা হুসেইন সহযোগী অধ্যাপক, নিউইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয়
তা সত্ত্বেও ভাট কখনো ভুলে থাকতে পারেননি যে, তিনি নাগরিকত্বের প্রচলিত নিয়মে ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে পারেননি। ভারত সরকার কখনো তাঁর পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়নি। আজীবন ভাটের পরিচয় হয়ে থাকল, তিনি একজন কাশ্মীরি, যাঁর পাসপোর্ট পাকিস্তানের, কিন্তু বসবাস ভারতে।
ভাটের ওই আত্মীয় বলেন, ‘তিনি বিয়ে করেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, তিনি না পাকিস্তানি হিসেবে স্বীকৃত, না ভারতীয় হিসেবে।’ এই আত্মীয় আরও বলেন, ‘তিনি সব সময় নজরদারির মধ্যে থাকতেন। তাই মনে করতেন, একজন মেয়ের জীবন নষ্ট না করাই ভালো।’
স্বাস্থ্যের অবনতি
ভাট একাকী থাকতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে।
২০১৬ সালে তাঁর বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন তাঁর দেহে একাধিক স্টেন্ট বসানো হয়। হার্টের ধমনি ব্লক বা সরু হয়ে গেলে, সেখানে রক্ত চলাচল সচল রাখতে স্টেন্ট বসানো হয়।
পাঁচ বছর পর ২০২১ সালে তাঁর প্রথম স্ট্রোক হয়। এরপর ২০২২ ও ২০২৩ সালে আরও দুটি স্ট্রোক হয়। মৃত্যুর ঠিক দুই মাস আগে চতুর্থ স্ট্রোকে তিনি পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এরপর ভাটকে শ্রীনগরের উপকণ্ঠে তাঁর একমাত্র জীবিত বোনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর ওই স্বজন বলেন, ‘তিনি নিজে কিছু খেতে পারতেন না, পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে চিকিৎসা–সংক্রান্ত একটি নথিতে বলা হয়েছে, ভাটের ‘কয়েক বছর আগে হওয়া মস্তিষ্কে স্ট্রোক… একধরনের নিউরোমাসকুলার প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন।’
স্ক্রলের হাতে আসা এই নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভাট ‘পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শয্যাশায়ী’ এবং এই প্রতিবন্ধিতা ‘স্থায়ী বলে মনে হয়।’ ‘তিনি একদমই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে নথিতে।
এই নথিতে আরও উল্লেখ আছে, ভাট ‘মনোচিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ (সাইকোট্রপিক মেডিকেশন)’ গ্রহণ করছিলেন। কারণ ‘শারীরিক চাপ’ তাঁকে ‘খিটখিটে’ এবং ‘ঝগড়াটে’ করে তুলেছিল।’…‘তাঁর মঙ্গলের জন্য তাঁকে কখনোই তদারকিহীন অবস্থায় একা ফেলে রাখা উচিত নয়’ বলেও সতর্ক করা হয়েছিল চিকিৎসকেরও ওই নথিতে।
দেশছাড়া
‘ভারত ছাড়ার নোটিশ’ ভাটের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার দুই দিন পর পুলিশ কর্মকর্তারা কয়েকবার ভাটের বাড়িতে যান। তারা তাঁর ছবি তোলেন এবং জানিয়ে দেন, তাঁকে ভারত ছাড়তেই হবে। তাঁর এক আত্মীয় বলেন, ‘কিন্তু ভাট কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।’
ভাটকে যেন দেশছাড়া করা না হয়, এ জন্য তাঁর পরিবারের সদস্যরা পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকবার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সেই আদেশ কার্যকর করেছি মাত্র।’
ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ভাটের পরিবার প্রশাসন ও পুলিশকে তাঁর চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্র দিয়েছিল। কিন্তু ‘তখন পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ থাকায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না’।
সেই রাতেই রাত ১১টার দিকে ভাটের এক আত্মীয়কে স্থানীয় থানা থেকে ফোন করা হয় এবং ভাটকে থানায় নিয়ে আসতে বলা হয়। ‘তাঁরা কিছু ছবি তুলতে হবে বলে জানিয়েছিলেন’ বলেন জানান ভাটের ওই আত্মীয়। তিনি বলেন, ‘ভাটকে নিয়ে থানায় পৌঁছার পর আমাদের জানানো হয়, স্টেশন থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাঁকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাবেন।’
শ্রীনগরের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে ভাটের পরিবার বুঝতে পারে, তাঁকে এখনই ভারতছাড়া করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁরা সেখানে আরও অনেক সাধারণ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে এবং তিনটি বাস প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পান। ভাটের আত্মীয় জানান, ‘২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ কর্মকর্তারা এসব মানুষকে ওই বাসগুলোতে তুলে পাঞ্জাবের পথে রওনা দেন।’
ভাটের আত্মীয়ের দাবি, বাসগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি ছিল। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের বাসগুলো অনুসরণ করে সঙ্গে যেতে দেওয়া হয়নি।
তবে প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা স্ক্রলকে বলেন, দেশছাড়ার জন্য যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সীমান্ত পর্যন্ত যেতে বাধা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘ভাটের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরে বসবাসকারী আরও ৩৬ জন পাকিস্তানি নাগরিককে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা যদি বাসগুলো অনুসরণ করে ওয়াঘা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভাটের পরিবার কেন পারেননি?’
ভারত সরকার কখনো ভাটের পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়নি। আজীবন ভাটের পরিচয় হয়ে থাকল, তিনি একজন কাশ্মীরি, যাঁর পাসপোর্ট পাকিস্তানের, কিন্তু বসবাস ভারতে।
প্রায় দেড় দিন ধরে পরিবারের কাছে ভাটের কোনো খোঁজ ছিল না। ৩০ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে পাঞ্জাবের একটি থানা থেকে শ্রীনগরে থাকা তাঁর পরিবারকে ফোন করে জানানো হয়, ভাট মারা গেছেন।
ভাটের শেষ মুহূর্তগুলো কীভাবে কেটেছে, তা নিয়ে পরিবার এখনো অন্ধকারে। ভাটের ওই আত্মীয় বলেন, ‘আমরা অন্য এক ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছি, তিনি পানিশূন্যতায় মারা গেছেন। সম্ভবত তিনি পুরো সময়টাই বাসে ছিলেন। সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় কারও কাছে পানি বা সাহায্য চাইতেও পারেননি।’
১ মে রাতে শ্রীনগর প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় ভাটের মরদেহ বাড়িতে আনা হয়।
পরদিন সকাল প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে ভাটকে দাফন করা হয় শ্রীনগরের মলখা এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে। আত্মীয়টি বলেন, ‘যেখানে তিনি জন্মেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন, সেই খনিয়ার এলাকায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।’
ভাটের নিঃসঙ্গ মৃত্যু তাঁর পরিবারকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তাঁদের সামনে এখন অনেক প্রশ্ন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাটের যে আত্মীয় স্ক্রলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি বলেন, আবদুল ওয়াহিদ ভাটকে কে হত্যা করেছে? এই প্রশ্নটি চিরকাল রয়ে যাবে।