ভারতের পাহাড়ি ঢলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ফেনীর ৩৫ গ্রাম প্লাবিত

‘জেলার পরশুরামে অন্তত ১৫টি ও ফুলগাজীতে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দু’উপজেলায় ১৩১টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২ শতাধিক মানুষ, দু’শতাধিক গবাদি পশু আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।’
ফেনীতে বৃষ্টিপাত কমলেও ভারতের পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অন্তত ১৭ স্থানে ভেঙে গেছে। বৃষ্টিপাত কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ-ভারত টাইবাঁধের সংযোগস্থল আলোচিত বল্লামুখা বাঁধের ভাঙ্গনস্থল দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে দু’উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে ফেনী বিলোনিয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বুধবার (৯ জুলাই) ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মজিবুর রহমান জানান, জেলায় সোমবার সকাল ৯টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় ৫৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের সর্বাধিক ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ফেনীতে। তবে রাত থেকে ভারী হতে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাত ১২ টা থেকে আজ বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৯৮ মিলিমিটার। আজ বিকেল তিনটা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে নদীর পানিও কিছুটা কমেছে বলে জানা গেছে।
ফেনী পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন জানান, বৃষ্টিপাত কমায় ফেনী শহর এলাকার পানি প্রধান প্রধান সড়ক থেকে নেমে গেছে। তবে শহরের নিচু এলাকা এখনো পানি রয়েছে। পরিছন্নতা কর্মীরা সার্বক্ষণিক কাজ করছেন।
পৌরসভার বাসিন্দারা জানান, শহরের খাল ড্রেন বেদখল ও অপরিচ্ছন্ন থাকায় বৃষ্টি হলেই শহর পানিতে তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মুহুরী নদীর পরশুরাম গেজ ষ্টেশন মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে পানির লেভেল ৬ দশমিক ৯৭ মিটার, রাত ৮টার দিকে ১৩ দশমিক ৮৫ মিটার ছিল। বিপদসীমা ১২ দশমিক ৫৫ মিটার।
এ সময়ে প্রায় সাত মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী নদীর ডান তীরে জিরো পয়েন্টে বাংলাদেশ-ভারত টাইবাঁধের সংযোগস্থল দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
মুহুরী নদীর উভয় তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পরশুরাম উপজেলায়, জঙ্গলগোনা-দু’টি (মুহুরী, ডান তীর), উত্তর শালধর-একটি (মুহুরী নদীর ডান তীর), নোয়াপুর-একটি (মুহুরী নদীর বাম তীর), পশ্চিমে একটি (মুহুরী নদীর বাম তীর), ডি এম সাহেবনগর- একটি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর), পশ্চিম গদানগর- একটি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর), দক্ষিণ বেড়াবাড়ীয়া-একটি (কহুয়া নদীর বাম তীর), পূর্ব সাতকুচিয়া-একটি (কহুয়া নদীর ডান তীর), উত্তর টেটেশ্বর-একটি (কহুয়া নদীর বাম তীর) সহ ১০টি স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে এবং ফুলগাজী উপজেলায় দেড়পাড়া-দু’টি (মুহুরী নদীর ডান তীর), শ্রীপুর-একটি (মুহুরী নদীর ডান তীর), উত্তর দৌলতপুর -একটি (কহুয়া নদীর ডান তীর), কমুয়া-একটি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর)-সহ পাঁচটি, সর্বমোট ১৫টি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র আরো বেশি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে মুহুরী কুহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বিভিন্ন স্থানে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। বাড়ি ঘর পানিতে তলিয়ে যায়। গবাদি পশু, মাছের খামার, কৃষি, রাস্তাঘাট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধ সংস্কারে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও সঠিকভাবে কাজ না করায় যথারীতি বৃষ্টি হলে অথবা ভারতের উজানের পানির চাপে বাঁধ ভেঙে যায়।
আমাদের ফুলগাজী সংবাদদাতা সাঈদ হোসেন সাহেদ জানিয়েছেন, ‘ভারতের উজানের পানিতে বিগত বছরের ন্যায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা না গেলেও ইতোমধ্যে অনেক গবাদি পশু, খামারের মাছ, বসত ঘর পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ফেনী বিলোনিয়া সড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে মানুষ বুক সমান পানি ডিঙিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, রেড ক্রিসেন্ট, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার জানান, প্রবল বেগে ভারতের উজান থেকে পানি আসায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি উপচিয়ে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। সবশেষ সকাল ৯টার দিকে পানির লেভেল ১৩ দশমিক ৩১ মিটার। দুপুর থেকে বিপদ সীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত কমলেও ভারতের উজানের পানি আসা বন্ধ না করলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে সময় লাগবে।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, জেলার পরশুরামে অন্তত ১৫টি ও ফুলগাজীতে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দু’উপজেলায় ১৩১টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২ শতাধিক মানুষ, দু’শতাধিক গবাদি পশু আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মনিটরিং এর জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।তিনি সার্বক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরেজমিনে খোঁজখবর রাখছেন।
এদিকে পুলিশ সুপার মো: হাবিবুর রহমান জানান, পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলার সব থানায় পুলিশ সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে। মঙ্গলবার রাতে জেলা প্রশাসকসহ তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক ওসমান গনি রাসেল জানান, জেলার স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকটি টিম ইতোমধ্যে ফুলগাজী ও পরশুরামে অবস্থান করছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও মালামাল সরিয়ে নিতে তারা তৎপর রয়েছেন। এছাড়া জেলা সদরেও স্বেচ্ছাসেবকরা তৎপরতা চালাচ্ছেন।
অপরদিকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বন্যা কবলিত মানুষের সাহায্যে কাজ করছেন বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।